৫ ফুট ৮ ইঞ্চির একজন মানুষ। তার মুখভর্তি দাড়ি। পরনে গেঞ্জি, প্যান্ট ও পায়ে স্যান্ডেল। অতি সাধারণ তার চলাফেরা। অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করা হয়নি। রাজধানীর পল্টনে একটি বইয়ের দোকান আছে। পাশাপাশি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবিকালচার অনুষদের বাগান পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করেন। দুটি কাজ করেই সংসার চালান দুই সন্তানের বাবা উৎপল চন্দ্র রায়।

স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে এবং ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ছেন। আপনি জেনে হয়তো অবাক হবেন, সাধারণ এ মানুষটি বিখ্যাত এক ভাস্কর্যের মডেল। হ্যাঁ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত রাজু ভাস্কর্যের মডেল।

তার জন্ম ১৯৮৫ সালের ১৫ জুন। গ্রামের বাড়ি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। বাবার কর্মস্থল ঢাকায় হওয়ায় ছোটবেলা থেকে রাজধানীতেই বেড়ে উঠেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের রাজু ভাস্কর্যটি নিশ্চয় দেখেছেন! সেখানকার ৮ জন মডেলের মধ্যে তিনিও একজন। তবে তিনি বাদে বাকি ৭ জনই ছাত্র। উৎপল কীভাবে রাজু ভাস্কর্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন?

তিনি বলেন, ‘পল্টনে আমার বইয়ের দোকানের সূত্র ধরে শ্যামল দাদার (ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী) সঙ্গে পরিচয় আমার। ভাস্কর্য তৈরির জন্য তার মডেল দরকার ছিল। তখন শ্যামল দাদা আমাকে মডেল হিসেবে নির্বাচন করেন। এখন রাজু ভাস্কর্য সারাদেশে বিখ্যাত ও কীর্তিমান ভাস্কর্যের মধ্যে একটি।’

রাজু ভাস্কর্যের একজন মডেল হয়ে উৎপল গর্বিত। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি ভাস্কর্যটি এত বিখ্যাত হবে। রাজু ভাস্কর্যের মডেল হওয়া আমার জীবনের বিরাট একটা পাওয়া। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’

ভাস্কর্য তৈরির দিন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত উৎপল নিজের সাধ্যমতো শ্রম দিয়েছেন সেখানে। ভাস্কর্য তৈরির সময় তার একটি স্মরণীয় ঘটনাও রয়েছে। তিনি জানান, টানা ১৫ দিন তাকে মডেল হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে ভাস্কর্যের কাজ চলাকালে তাকে মাঝে মাঝে সেখানে ঘুমাতেও হয়েছে।

জগন্নাথ হলে থাকায় তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে উৎপলের পরিচয় ছিল। তাদের মাধ্যমেই রাজুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। রাজুর সঙ্গে যদিও উৎপলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। তবে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় রাজুকে তিনি খুব কাছ থেকে জেনেছেন।

রাজু সম্পর্কে উৎপল বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে রাজু ভাই ছিলেন অসাধারণ। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যাতে সব সময় ভালো থাকে; সেদিকে খেয়াল রাখতেন। ক্যাম্পাস রাজনীতি অস্থিতিশীল থাকলেও ছাত্র রাজনীতিতে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ক্যাম্পাসের যেখানেই অপরাধ-অনিয়ম দেখতেন; সেখানেই প্রতিবাদ করতেন। রাজু ভাই ছিলেন প্রতিবাদী মানসিকতার মানুষ।’

রাজু যখন গুলিবিদ্ধ হন; তখন তিনি ছিলেন শামসুন্নাহার হলের সামনে। রাজুর মৃত্যুসংবাদ শুনে উৎপলের হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হয়েছিল। রাজুর মৃত্যুর পর ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকেলেও ছাত্র না হওয়ায় তিনি তা পারেননি। রাজু মারা যাওয়ার পর তার বাবা-মায়ের সঙ্গেই উৎপল একবার সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

রাজুর মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে উৎপল বলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টি রাজুর মৃত্যুর পর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সোচ্চার ছিল।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীর গুলিতে মিছিলে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মইন হোসেন রাজু নিহত হন। রাজুসহ সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের সব শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় এ ভাস্কর্য।

ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী রাজু ভাস্কর্যের নকশাকার। তার জন্ম ১৯৬২ সালের পহেলা জানুয়ারি। তার পৈতৃক নিবাস নেত্রকোণা জেলার নিখিলনাদ রোডের আমতলায়। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর শ্যামলীতে। তার বড় মেয়ে আর্কিটেকচার ও ছোট মেয়ে ভারতে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করছেন।

শ্যামল চৌধুরী চারুকলায় ভাস্কর্য নিয়ে পড়েছেন। ঢাকা চারুকলায় বিএফএতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছিলেন। অধ্যয়নকালে তিনি প্রোট্রেট ফিগার ও হিউম্যান ফিগার নিয়ে কাজ করতেন। পড়ালেখা শেষে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন, এখনো করেন। কারণ তার চাকরি করার কোনো ইচ্ছা ছিল না।

শুরুতে ধণাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে বা অফিসে ভাস্কর্য ও মিউরাল তৈরির কাজ করতেন। এগুলো শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত, কোনো কাজে লাগত না। এ কাজগুলোকে বলা হয় কমিশন ওয়ার্ক। সে সময়ে তিনি মুক্তাঙ্গনে কাজ করার সুযোগ খোঁজেন। শ্যামল চৌধুরী তখন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়ায় ‘রাজু ভাস্কর্য’ তৈরির সুযোগ মেলে তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন কমিটি তার হাতে ভাস্কর্য তৈরির দায়িত্ব তুলে দেয়। মূলত রাজুর সহপাঠী ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগেই ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয়।

ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা রীতিমতো আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে ২৫ হাজার টাকা অর্থ সহযোগিতা পায়। যা না-কি ভাস্কর্যের জন্য ছিল সামান্য পরিমাণ অর্থ। তারপরও শ্যামল শহীদ রাজুর সহপাঠীদের উৎসাহ দেন কাজ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে।

১৯৯৫ সালের শেষ দিকে ভাস্কর্য তৈরির কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ করতে সময় লাগে এক বছর। কাজটি করতে কেউ কেউ টাকা দিয়েছেন, আবার অনেকে রড, সিমেন্ট, কোল্ডার চিপস স্টোন, আর্টিফিসিয়াল স্টোন কাস্টিং দিয়েও সহায়তা করেছেন।

এ কাজে যারা অর্থ ও ম্যাটেরিয়াল দিয়ে সহায়তা করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আতা খান ও মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম খান বাদল। আরও অনেকেই ভাস্কর্য তৈরিতে সহায়তা করেছেন।

যেমন ভাস্কর্যের কাজের শুরুটা হয় কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে। তারা অফিস দিয়ে সহায়তা করেন। রাজু ভাস্কর্যে যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে; তারা সবাই ভাস্কর্য তৈরিকালীন সময়ে শ্যামল চৌধুরীকে সহযোগিতা করেছেন। তারা হলেন- মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাইদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, গোলাম কিবরিয়া রনি ও উৎপল চন্দ্র রায়।

রাজু ভাস্কর্য তৈরিতে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। এ কাজের জন্য শ্যামল কোনো পারিশ্রমিক নেননি। কারণ তিনি অর্থ উপার্জনের জন্য কাজটি করেননি। মুক্তাঙ্গনে এটাই ছিল তার প্রথম কাজ। এজন্য কাজটি নিয়ে তাকে অনেক ভাবতে হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর রাজু ভাস্কর্য উদ্ধোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী।

রাজু ভাস্কর্যের বিশেষত্ব সম্পর্কে শ্যামল চৌধুরী বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। ভাস্কর্যে ছাত্রদের শক্তিশালী রূপ দেখানো হয়েছে ঐক্যবদ্ধতা দিয়ে। এটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বার্তা।’

ভাস্কর্য নিয়ে ২৩ বছর পর শ্যামল চৌধুরীর মূল্যায়ন ছিল এমন, ‘ভাস্কর্য বিখ্যাত হবে কি-না এটা ভেবে কাজ করিনি। তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। রাজু ভাস্কর্য এখন সারাদেশের আইকন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কোনো শক্তিশালী দলের সঙ্গে জিতলে মানুষ এখানে এসে উচ্ছ্বাস করে। সমাবর্তনের সময় ভাস্কর্যের সামনে শিক্ষার্থীরা ছবি তোলে। রাজু ভাস্কর্য তৈরি করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।’

রাজু ভাস্কর্যের রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ছোট স্থাপনা হলেও ভাস্কর্যটির গুরুত্ব অনেক। অথচ ২৩ বছরে মাত্র একবার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি নিয়মিত বাগান পরিচর্যা করতে পারে; তাহলে ভাস্কর্যটি কেন পরিচর্যা করতে পারবে না। ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয় তথা পুরো দেশের সম্পদ।’

শ্যামল চৌধুরী উল্লেখযোগ্য ১৭টি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজু ভাস্কর্য, বিজয় ৭১ ও নজরুল ভাস্কর্য। তাছাড়াও সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যও তার তৈরি করা।

ভবিষ্যতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরও ভাস্কর্য করতে চান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন; সুযোগ পেলে সেখানে একটি ভাস্কর্য করতে চাই। আমি যদি সুযোগ না-ও পাই, তারপরও আমি চাই এখানে একটি ভাস্কর্য হোক। অন্য কেউ হলেও সেটা করুক।’