পৃথিবীর শীর্ষ ধনী জেফ বেজোস যেন সময়েরও আগে চলেন। তিনি গড়েছিলেন অনলাইন বইয়ের দোকান, সেটি এখন সারা বিশ্বে ‘সবকিছুর দোকান’। 

পেরুর আন্দিজ পর্বত কিংবা মনতারো নদীর নাম মানুষ খুব একটা জানে না। কিন্তু সেখান শুরু হওয়া বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী আমাজনের নাম তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির বাচ্চারাও জানে। তেমনি গ্যারেজ বা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় বিশ্বখ্যাত কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, সেটিও মানুষের অজানা। আমাজন নামের এই প্রতিষ্ঠানকে এখন গোটা পৃথিবী চেনে।

ই-কমার্স আমাজনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেফ বোজোস টানা ২৭ বছর দায়িত্ব পালনের পর চলতি মাসের গোড়ার দিকে হঠাৎ করেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা বেজোস সম্পূর্ণ অবসর নেননি। সিইওর পদ ছাড়লেও তিনি নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এর ফলে তিনি আমাজনের নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও অন্যান্য উদ্যোগে মনোযোগ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ‘সময় ও শক্তি’ পাবেন বলে মনে করেন।

৫৭ বছরের জেফ বেজোস তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে আমাজনের অন্যতম সফল সহযোগী ক্লাউড কম্পিউটিং বিভাগ আমাজন ওয়েব সার্ভিসেসের (এডব্লিউএস) ৫৩ বছর বয়সী সিইও অ্যান্ডি জ্যাসির নাম ঘোষণা করেছেন।

ফাঁকা মাঠে রাজসিক যাত্রাঃ  

শুধু অনলাইন বুক শপ বা অনলাইন বইয়ের দোকান হিসেবে ১৯৯৪ সালে আমাজনের যাত্রা শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে ‘সবকিছুর দোকান’ হিসেবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই ব্যবসার শুরুটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বেলভ্যুর বাড়ির গ্যারেজ থেকে। বেজোস প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘কাদাব্রা’ বা ‘রিলেন্টলেস’। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাজন নামটাই বেছে নেন।।

প্রথম মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের সব কটি এবং বিশ্বব্যাপী অন্তত ৪৫টি দেশ থেকে আমাজন বই বিক্রির আদেশ পায়। এরপর আমাজনকে তিনি যেন অর্থ উপার্জনের বিরতিহীন যন্ত্রে পরিণত করেন। সেই সুবাদে এটি বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে ওঠে এসেছে। বর্তমানে এই কোম্পানির সম্পদমূল্য হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আর বিশ্বব্যাপী আমাজনের জনবলের সংখ্যা ১৩ লাখ।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ খুচরা বই বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বার্নস অ্যান্ড নোবল কিংবা অন্য কেউ ইন্টারনেটে বই বিক্রি শুরু না করায় ফাঁকা মাঠে একচেটিয়া খেলার সুযোগ পেয়ে যান জেফ বেজোস। শুরুটা করেন বর্ডারস ও বার্নস অ্যান্ড নোবলের বই-ই বিক্রির মধ্য দিয়ে। বছর তিনেকের মধ্যেই আমাজনের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারে ওঠে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করেন বেজোস। তালিকাভুক্তির প্রথম বছরেই আমাজনের ব্যবসা ৪২ গুণ বৃদ্ধি পায়।

১৯৯৮ সালে আমাজন অনলাইনে সিডি, ডিভিডি, জামাকাপড়, খেলনা, অফিসে ব্যবহার্য পণ্যসহ কত কী বিক্রি করতে শুরু করে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠে। বদৌলতে আমাজন ‘পৃথিবীর বৃহত্তম বইয়ের দোকান’ থেকে ‘পৃথিবীর বৃহত্তম সিলেকশন’ হয়ে ওঠ।।

১৯৯৯ সালে আমাজন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমাজনের পণ্য বিক্রি শুরু চরম সফলতা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় আমাজনের মোট বিক্রির ৬০ শতাংশই এখন তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে পণ্য বিক্রি করার মাধ্যমে আসে।

জেফ বেজোস ২০০৫ সালে আমাজন প্রাইম নামে নতুন লয়্যালটি কর্মসূচি চালু করেন। এর আওতায় বছরে ৭৯ ডলার চাঁদার বিনিময়ে প্রাইম গ্রাহকদের কাছে বিনা মূল্যে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয়। আমাজন নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থাও চালু করে। গ্রাহক চাহিদা পূরণের এই উদ্যোগ একদিকে তাঁর অনলাইন ব্যবসায় বিপ্লব ঘটায়, অন্যদিকে সব প্রতিযোগী পিছিয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে আমাজন দুই দিনের বদলে এক দিনেই পণ্য জাহাজীকরণের ব্যবস্থা জোরদার করে।

ক্লাউড কম্পিউটিং সেবাঃ

২০০৬ সালে বিভিন্ন ব্যবসায়র জন্য আমাজন ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা চালু হয়। আমাজন ওয়েব সার্ভিস নামের এই সেবা খুব দ্রুত নেটফ্লিক্স থেকে নাসা পর্যন্ত সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ফলে ব্যবসাটি ভীষণ পয়মন্ত হয়ে ওঠে। ২০১৯ সালে শুধু আমাজন দুনিয়াজুড়ে ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে।

অন্যান্য ব্যবসাঃ

আমাজন ২০১৭ সালে ১ হাজার ৩৪০ কোটি ডলারের বিনিময়ে হোল ফুডসকে অধিগ্রহণের মাধ্যমে অনলাইনের পাশাপাশি স্টোর বা বিক্রয়কেন্দ্রভিত্তিক ব্যবসায়ও নাম লেখায়। এসব স্টোরে শত শত পণ্য বিক্রি করা হয় তুলনামূলক কম দামে।

২০১৮ সালে জেফ বেজোস প্রথমবারের মতো আমাজন গো স্টোর চালু করেন। এই স্টোরে ভোক্তাদের কোথাও দাঁড়াতে বা অপেক্ষা করতে হয় না। তাঁরা শুধু পছন্দের পণ্যগুলো ঝুড়ি বা ট্রলিতে ভরেন আর তা সঙ্গে সঙ্গেই ক্যামেরা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে গঠিত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ওঠে যায়।

সব ধরনের প্যাকেজ ডেলিভারিসহ বেজোস বা আমাজনের আরও যেসব ব্যবসা ও উদ্যোগ রয়েছে ডে ওয়ান ফান্ড, দ্য বেজোস আর্থ ফান্ড, ব্লু অরিজিন, ওয়াশিংটন পোস্টস্ট্রিমিং ভিডিও, বিজ্ঞাপন, ডেটাবেইস, অ্যানালিটিকস টুল, কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক, মেশিন লার্নিং সফটওয়্যার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি।।

পৃথিবীর শীর্ষ ধনীঃ
ব্যবসা শুরুর বছর চারেকের মাথায় ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস ম্যাগাজিনের তৈরি বিলিয়নিয়ার তালিকায় স্থান পেয়ে ব্যক্তি বেজোস বৈশ্বিক আলোচনার পাদপ্রদীপে চলে আসেন। ওই বছরে তিনি ১৬০ কোটি ডলারের নিট সম্পদ নিয়ে বিশ্বের ১০২তম শীর্ষ ধনী হন। এরপর ক্রমাগত উন্নতির সুবাদে ২০১৭ সালে এসে তিনি বহু বছরের শীর্ষ ধনী মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে পেছনে ফেলে বিশ্বের ১ নম্বর ধনীর মর্যাদা লাভ করেন। তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে তিনি ১৮ হাজার ৯৭০ কোটি ডলারের সম্পদ নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনী। পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে ২০২০ সালের আগস্টে বেজোসর সম্পদের মূল্যমান ২০ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করে।

২০২০ সালে করোনার কারণে অনলাইনে পণ্য বিক্রি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাজনের মোট বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, যা আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। আর ২০২০ সালে আমাজনের মুনাফা হয়েছে ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের দ্বিগুণ।

নতুন সিইও অ্যান্ডি জ্যাসিঃ

জেফ বেজোসের উত্তরসূরি হিসেবে আগামী জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দায়িত্ব নেবেন অ্যান্ডি জ্যাসি, যিনি ২০১৬ সাল থেকে আমাজনের ক্লাউড কম্পিউটিং বিভাগ আমাজন ওয়েব সার্ভিসেসের (এডব্লিউএস) সিইও। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করা অ্যান্ডি জ্যাসি ১৯৯৭ সালে আমাজনে যোগ দেন। ২০০৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এডব্লিউএস। বর্তমানে ছোট স্টার্টআপ থেকে শুরু করে পিন্টারেস্ট, স্ল্যাক, লিফট, অ্যাপল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পর্যন্ত লাখ লাখ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এডব্লিউএসের সেবা ব্যবহার করে। বিশ্বব্যাপী ক্লাউড অবকাঠামো সেবার ৩৩ শতাংশ সরবরাহ করে আমাজন, যা মাইক্রোসফটের ১৮ শতাংশ ও গুগলের ৯ শতাংশ। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে এডব্লিউএসের আয় ২৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।।

২০০২ সাল থেকে বেজোসকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে আসছেন অ্যান্ডি জ্যাসি। তাঁকে বেজোসের ব্রেইন ডাবল বা ছায়াও (শ্যাডো) বলা হয়। কারণ, বেজোসের মনে প্রশ্ন জাগার আগেই যেন তিনি তা অনুমান করতে পারেন, কিংবা বেজোসের মতোই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর মাথার ওপর নির্বাহী চেয়ারম্যান বেজোস থাকলে জ্যাসির পথচলা মসৃণই হওয়ারই কথ।।

সূত্র: বিবিসি, বিজনেস ইনসাইডার, ফোর্বস, নিউইয়র্ক টাইমস।