রাজশাহীতে অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া দুই শিশু মুনতাহা মারিশা ও মুফতাউল মাসিয়ার মৃত্যু নিয়ে রাজশাহীজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মারা যাওয়া দুই বোনকে গ্রামের বাড়িতে জেলার দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে।

বড় বোন মাসিয়ার নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার মধ্যে নমুনার রিপোর্ট রাজশাহীতে এসে পৌঁছাবে বলে জানা যায়।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মারা যাওয়া শিশু দুটির বাবা মঞ্জুর হোসেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক। পরিবার নিয়ে তিনি ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারে থাকেন। মারা যাওয়া দুই শিশুকে গত বুধবার গাছতলা থেকে বরই কুড়িয়ে এনে খেতে দিয়েছিলেন গৃহকর্মী। বরইগুলো ধোয়া ছিল না। বরই খাওয়ার পর দিন গত বৃহস্পতিবার ছোট মেয়ে ও গতকাল শনিবার বড় মেয়ের মৃত্যু হয়। তবে তারা নিপাহ ভাররাসে না কি অন্যকোনো অজানা ভাইরাসে মারা গেছেন তা এখনো নিশ্চিত নন চিকিৎকরা।

এদিকে অজানা ভাইরাসে দুই শিশু মারা যাওয়ার ঘটনায় চারঘাটের সারদাহ ক্যাডেট কলেজ ও এর আশপাশে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুধু সেখানেই নয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও মারা যাওয়া দুই শিশুর বাবা-মাকে হাসপাতালের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

শিশুর বাবা-মায়ের নমুনাও সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে দায়িত্বরত চিকিৎকরা জানিয়েছেন।

সারদা ক্যাডেট কলেজ মোড়ের সাইকেল মেকার মোস্তফা বলেন, আমি নিয়মিত ক্যাডেট কলেজের ভেতরে বিভিন্ন প্রয়োজনে যেতাম। কিন্তু বাচ্চা দুটি মারা যাওয়ার পর সেখানে আমাদের বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভেতরে যারা আছেন তারা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। ভেতরে যারা আছেন তারা সবাই মাস্ক ব্যবহার করছেন। একই পরিবারের দুই শিশু হঠাৎ এভাবে মারা যাওয়ায় আমরা ক্যাডেট কলেজের আশপাশের বাসিন্দারাও একটু শঙ্কিত।

রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্জেন্ট (সিএসএম) মাহবুব বলেন, বাচ্চা দুটি আসলে কীভাবে মারা গেল এটির সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাচ্চা দুটি যেহেতু কাজের মহিলার কাছে ছিল সুতরাং সে বরই খাইয়েছে এমন একটি কথা আসছে। ওই কাজের মহিলা যদি দুধ খাওয়াইতো তাহলে হয়তো কথা আসতো, দুধের সাথে হয়তো কিছু একটা মিশিয়েছে। শুনেছি নমুনা ঢাকায় পাঠিয়েছে। আগামীকাল সোমবার সকালের মধ্যেই জানা যাবে, শিশু দুটি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন না কি অন্য কোনো রোগে।

চারঘাট পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর খোদা বখ্শ বলেন, ক্যাডেট কলেজ ঘেঁষেই গ্রাম। গত পরশু দিন ও গতকাল ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারে অসুস্থ হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু নিয়ে আমার এলাকার লোকজন চরম আতঙ্কে রয়েছে। এটি নিপাহ ভাইরাস না কি অন্যকোনো ভাইরাস জানা যায়নি। এলাকাতেও এটি ছড়িয়ে পড়বে কি না তা নিয়ে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত। তাই শিশু দুটি আসলে কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল, তা দ্রুত অনুসন্ধানে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে এলাকাবাসী উপকৃত হতাম।

হাসপাতালের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে যেখানে শিশু দুটির বাবা মঞ্জুর ও মা পলি খাতুনকে রাখা হয়েছে সেখানে স্বজন রইস উদ্দিন দেখভালের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, বাচ্চা দুটি তো মারা গেছে। তাদের বাবা-মাকেও হাসপাতালে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বাড়িতে মঞ্জুর রহমানের বৃদ্ধ মা আহাজারি করছেন। তাকে থামানো যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন।

দুর্গাপুরের চুনিয়াপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মারা যাওয়া শিশু দুটিকে বাড়ির পাশেই দাফন করা হয়েছে। দাফন কাজে ব্যবহৃত খাটটি এখনো বাড়ির আঙিনায় রাখা আছে। পরিবারের সবাই কষ্টে মুহ্যমান হয়ে যে যার মতো নির্বাক হয়ে বসে আছে।

শিশু দুটির দাদি মোসা. আনজোয়ারা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি এই কষ্ট কেমনে সইব। ছোট দুই নাতনিই আমার দুই দিনের ব্যবধানে এভাবে চলে গেল। সবসময় আমাকে সারাক্ষণই দাদু দাদু বলে ডাকত।

শিশু দুটির মা পলি খাতুন বলেন, ছোট মেয়েটি আমাকে যখনই কাছে পেত তখনই চুম্মু খেত। এত বেশি চুম্মু খেত, আমি নিজেই মাঝে মাঝে ভাবতাম মেয়ে আমার কেন এত বেশি চুম্মু খাচ্ছে। এই বলেই মুর্ছা যাচ্ছেন মা পলি।

রামেক হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, সকালেও তিনি ওই দম্পতিকে দেখেছেন। শিশু দুটির মায়ের গায়ে একটু জ্বর আছে। তারা নিজেরা বরই খাননি বলে জানিয়েছেন। তবে তারা দুটো বাচ্চাকেই কাছে রেখেছিলেন। শিশুদের মাধ্যমে মা-বাবার শরীরেও ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। এই আশঙ্কায় তাদের হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। পরীক্ষায় নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত না হলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। বিকেল নাগাদ পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যেতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে এই চিকিৎসক বলেন, শিশু দুটির গায়ে ছোপ ছোপ কালো দাগ ছিল। কিন্তু এটি নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ নয়। তাই আমরা সন্দিহান এটি নিপাহ ভাইরাস না কি অন্যকোনো অজানা ভাইরাস। এমন রোগ আমি জীবনে প্রথমে দেখলাম। যদি অন্যকোনো ভাইরাস হয়ে থাকে তাহলে এটি শনাক্তের কোনো উপায় দেশে নেই।