ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে গত ৫ এপ্রিল সৌদি আরবে যান সাবেক যুবলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান। ২০ এপ্রিল দেশে ফেরেন তিনি। দুদিন ঢাকার বাসায় থেকে ঈদের দিন (২২ এপ্রিল) গ্রামের বাড়িতে আসেন নোমান। গ্রামে আসার পরই সন্ত্রাসীরা তাকে টার্গেট করে। তিনদিনের মাথায় অনেকটা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো যুবলীগের সাবেক এ নেতাকে। তার সঙ্গে থাকায় বলি হতে হয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রাকিব ইমামকেও। এ নিয়ে জেলাজুড়ে চাঞ্চল্যের ‍সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুব্ধ দলীয় নেতাকর্মীরাও।

মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) রাত পৌনে ১০টার দিকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাটে জেলা যুবলীগের সাবেক নেতা নোমান ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রাকিব ইমামকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।

হাসপাতালে নেওয়ার পর নোমানকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। গুরুতর আহত অবস্থায় রাকিবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকায় নেওয়ার পথে নোয়াখালীতে তার মৃত্যু হয়।

নিহত নোমান সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি প্রস্তাবিত জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। তিনি দুই ছেলে সন্তানের জনক। আর রাকিব বশিকপুর নন্দীগ্রামের রফিকউল্যার ছেলে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলীয় একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, পরিকল্পিতভাবে যুবলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। মূলত ওমরা থেকে গ্রামে ফেরার পরই তাকে টার্গেট করে প্রতিপক্ষরা। এছাড়া বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম জেহাদী গত ২০ ডিসেম্বর তাকে মারধরের হুমকি দিয়েছিলেন। বশিকপুর ভাই ভাই অডিটোরিয়ামে প্রকাশ্যেই তিনি নোমানকে হুমকি দেন। ফলে সন্দেহের তীর তার অনুসারীদের দিকেই বেশি যাচ্ছে।

হত্যাকাণ্ডের পর এ নিয়ে বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম জেহাদীর বা তার পক্ষের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নোমানের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৫ এপ্রিল ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যান আব্দুল্লাহ আল নোমান। গত ২০ এপ্রিল তিনি দেশে ফেরেন। এরপর ঢাকার বাসা থেকে ঈদের দিন বশিকপুর গ্রামে যান। ঈদের দিন পোদ্দারবাজারে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি। এরপর পরিবারের সঙ্গে বাড়িতেই দুদিন কাটান নোমান।

ঘটনার দিন মঙ্গলবার রাতেও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে পোদ্দারবাজারে ছিলেন তিনি। তাদেরকে বিদায় দিয়ে নাগেরহাটের দিকে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেলে তার সঙ্গে ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রাকিব ইমাম। নাগেরহাটের কাছাকাছি পৌঁছালে সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি ছোড়ে। এতে দুজনই গুলিবিদ্ধ হন। এসময় তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও নোমানের মোবাইল ফোনও নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।

নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি সরাসরি সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম জেহাদীকে দায়ী করেছেন। মাহফুজুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসী আবুল কাশেম জেহাদী পরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে হত্যা করেছে। কাশেম আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা (ইউপি নির্বাচনে) করেও হেরেছিল। এরপর থেকে আমাদের হুমকি দিয়ে আসছিল। টার্গেট করে নোমান-রাকিবকে তারা খুন করেছে।

আলোচনায় ইউপি নির্বাচন নিয়ে ‘দ্বন্দ্ব’
নোমান-রাকিব হত্যাকাণ্ডের পর অনেকটা থমথমে লক্ষ্মীপুর। চলছে নানান আলোচনা। খুনিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার মাঠে নেমেছে পুলিশ। তবে এখনো এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তবে এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে সর্বশেষ বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসছে। স্থানীয়রাও ধারণা করছেন, ওই নির্বাচন ঘিরে যে দ্বন্দ্ব দানা বেঁধেছিল, তার জেরে নোমান-রাকিব খুন হতে পারেন।

স্থানীয়রা জানান, বশিকপুর ইউপি নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সাবেক চেয়ারম্যান ও চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম জেহাদী। তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েন মাহফুজুর রহমান। তিনি নিহত আব্দুল্লাহ আল নোমানের ভাই।

নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আবুল কাশেম জেহাদীর ভরাডুবি হয়। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মাহফুজুর রহমান। ওই নির্বাচন নিয়েই কাশেম জেহাদী ও তার অনুসারীদের সঙ্গে মাহফুজ-নোমান গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পরে বলে ধারণা স্থানীয়দের।

এদিকে, ঘটনার পর খবর পেয়ে দ্রুত সদর হাসপাতালে ছুটে যান লক্ষ্মীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ। তিনি বলেন, কেন, কী কারণে, কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।পরে রাতে তিনি হত্যাকাণ্ডের স্থানও পরিদর্শন করেছেন। জানিয়েছেন, পুলিশ অপরাধীদের চিহ্নিত করতে তৎপর রয়েছে।

আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ-সমাবেশ
যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ মিছিল করা হয়। পরে তারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবির পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম পলাশ, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আহমেদ পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবর প্রমুখ। তারা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতাকে হত্যায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবি জানান।

জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন,আমরা এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম জেহাদীর মোবাইল ফোনে কল করে বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু জাগো নিউজকে বলেন, কেউ কেউ লক্ষ্মীপুরকে অশান্ত করতে চায়। আমরা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বশিকপুরের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র জব্দের দাবি জানাচ্ছি। সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।