চলতি বছরের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি প্রায় তিন মাস। নির্বাচন সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংগুলো। নির্বাচনে পেশিশক্তি ও প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যবহার করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যবহার করছেন তারা। মূলত টাকা, মোটরসাইকেল ও ক্ষমতার লোভে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছে কিশোর গ্যাংগুলো।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, ডিএমপির আটটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুরে। মিরপুর বিভাগে কিশোর গ্যাংয়ের ১৩টি গ্রুপ রয়েছে, তাদের সদস্য সংখ্যা ১৭২ জন। তেজগাঁও বিভাগে রয়েছে সাতটি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ১২১ জন। রমনা বিভাগেও রয়েছে সাতটি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ১১৩ জন। ওয়ারী বিভাগে ছয়টি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ১০৮ জন। উত্তরা বিভাগেও ছয়টি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ৬৪ জন। গুলশান বিভাগে সাতটি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ৬৩ জন। মতিঝিল বিভাগে চারটি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ৩১ জন। লালবাগ বিভাগে দুটি গ্রুপ, তাদের সদস্য সংখ্যা ১০ জন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম থেকেই যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল কিশোর গ্যাংগুলো। যদিও গ্যাংগুলোর সদস্যরা মাদকের টাকা জোগাড় করতে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করে আসছিল। তবে, তা বিচ্ছিন্ন। দলবদ্ধভাবে অপরাধ করার ঘটনা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গ্যাংগুলো নতুনভাবে সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের সদস্যরা। মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতেই কিশোর গ্যাং ব্যবহার করছেন তারা।
বেপরোয়া কিশোর গ্যাং
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার ঘটনাটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। সেদিন ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় প্রকাশ্যে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। ঘটনার সময় সামনে যাদের পেয়েছে তাদের কুপিয়ে সঙ্গে থাকা সবকিছু নিয়ে গেছে গ্যাংয়ের সদস্যরা। এছাড়া রাস্তার পাশের ১৫-২০টি দোকানে লুটপাট ও ভাঙচুর চালিয়েছে তারা।
চলতি (অক্টোবর) মাসের প্রথম দিন কিশোর গ্যাংয়ের টার্গেটের শিকার হন শাক-সবজি ব্যবসায়ী শুক্কর (৪২)। অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মেটাতে সবজি বিক্রি করতেন নবাবগঞ্জের আগলা মধুরচরিয়ার গ্রামের শেখ ওয়াজউদ্দিন ছেলে শুক্কুর। ঘটনার দিন ভোররাতে সবজি কেনার জন্য শ্যামবাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন তিনি। অন্যদিকে, মাদকের টাকা জোগাড়ে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে টার্গেটের অপেক্ষায় ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পথিমধ্যে কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা খালপাড় রোড এলাকায় শুক্কুরের রিকশার গতিরোধ করে কিশোর গ্যাং সদস্য ইমন ও রুবেল।
রুবেল রিকশা আটকে রাখে এবং ইমন সবজি ব্যবসায়ী শুক্কুরকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এসময় দীপু, মন্টু ও হানিফ রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল, যাতে কোনো লোক দেখে না ফেলে। মাদকের টাকা জোগাড় করতেই পাঁচ বন্ধু মিলে হত্যা করে সবজি ব্যবসায়ী শুক্কুরকে। ছিনিয়ে নেয় তার ব্যবসায়িক ৩০ হাজার টাকা। এ ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মূলহোতা ইমনসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ।
শুধু ঢাকায়ই নয়, একই চিত্র সারাদেশে। গত ১৩ এপ্রিল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজিপুর গ্রামের মালেকার বাপের দোকান এলাকায় প্রবাসী মাওলানা আবু জাহেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কিশোর রিমন ও তার সহযোগীরা। সেসময় আবু জাহেরের কোলে তার একমাত্র সন্তান তাসফিয়া আক্তার (৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
সারাদেশে কিশোর গ্যাং দমনে ও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যেসব আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের মদতদাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা হবে। নির্বাচন সামনে রেখে যারা কিশোর গ্যাং গ্রুপ ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।— র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন
ফেসবুকে মন্তব্য করাকে কেন্দ্র করে ১৬ মে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পেশকারহাট এলাকায় দুই দল কিশোর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনায় চারজন আহত হয়। সেসময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে।
কিশোর গ্যাংয়ের শক্তিমত্তা জাহির করতে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে তারা নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও লাগাম টানা যাচ্ছে না কিশোর গ্যাংয়ের। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গ্যাংগুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। সময়ে সময়ে তারা অপরাধের কৌশল পরিবর্তন করেছে। ঢাকার যেসব এলাকায় মাদকের আখড়া বেশি সেসব এলাকায় শিশু গ্যাংয়ের তৎপরতাও তুলনামূলক বেশি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতারা বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের ভয়ে এলাকাবাসী অভিযোগ কিংবা মুখ খুলতে সাহস পায় না।
যত বড় শক্তিশালী কিশোর গ্যাং থাকুক না কেন ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং হবে। এসব গ্যাংয়ের মদতদাতাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। মদতদাতারা যে দলেরই হোক আইনের আওতায় আনা হবে।— ডিবিপ্রধান হারুন
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে কিশোর গ্যাং গ্রুপ ব্যবহার করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এলাকায় যারা নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন, তারা তাদের শক্তিমত্তা বাড়াতে কিশোর গ্যাং ব্যবহার করছেন। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি কিশোরদের কাছে নম্বরপ্লেটহীন মোটরসাইকেল তুলে দিয়েছেন। এতে এসব অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোররা মোটরসাইকেলের লোভে নানান অপরাধে জড়াচ্ছে। নির্বাচনের সময় এলেই এসব কিশোর রাজনৈতিক ব্যক্তির পক্ষ হয়ে কাজ করায় তাদের ভয়ে থাকে সাধারণ মানুষও। মূলত টাকা, ক্ষমতার লোভে নির্বাচনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয় কিশোর গ্যাং।
মিরপুর-মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাং বেশি
রাজধানীতে সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করছে ডিএমপি। এখন পর্যন্ত এ তালিকায় ৫২টি চক্রের নাম এসেছে। ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের অধীন ৩৩ থানা এলাকায় এসব চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬৮২।
ডিএমপির তথ্য বলছে, ডিএমপির আটটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুরে। মিরপুর বিভাগে কিশোর গ্যাংয়ের ১৩টি গ্রুপ রয়েছে, সদস্য সংখ্যা ১৭২ জন। তেজগাঁও বিভাগে সাতটি গ্রুপ, সদস্য সংখ্যা ১২১ জন। সবচেয়ে কম লালবাগ বিভাগে দুটি গ্রুপ, সদস্য সংখ্যা ১০ জন।
যত বেশি পেশিশক্তি ব্যবহার হবে নির্বাচন তত বেশি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে দূরে সরে যাবে। অতীতে দেখেছি, ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ, কোণঠাসা, ভোটের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে নানাভাবে অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। তবে, বর্তমানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শঙ্কা বা ভয়ের জায়গাটা কিশোর গ্যাং। কিন্তু কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় দায় রয়েছে।— অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক
এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরে ৫৭টি গ্যাংয়ে ৩১৬ জন সদস্য, খুলনা মহানগরে পাঁচটি গ্যাংয়ে ৩৫ জন, গাজীপুর মহানগরে পাঁচটি গ্যাংয়ে ৬৯ জন, ঢাকা বিভাগে ২৪টি গ্যাংয়ে ৩৪৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টি গ্যাংয়ে ১১৪ জন, খুলনা বিভাগে দুটি গ্যাংয়ে ১৩ জন, বরিশাল বিভাগে চারটি গ্যাংয়ে ৫৮ জন, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগে ১৮ জন করে একটি তালিকা করা হয়েছে।
উত্তরায় আদনান হত্যা ও নির্মমতা
রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মমতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের খেলার মাঠে তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে দুটি চক্রের প্রধানসহ আটজনকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
ডিএমপির তালিকা অনুযায়ী— উত্তরায় এমন ছয়টি চক্র রয়েছে, যাদের সদস্য সংখ্যা ৬৪ জন। ‘ইয়াং স্টার’, ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘বিগবস’ ইত্যাদি নামে সক্রিয় এসব চক্রের সদস্যরা পার্টি করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো এবং রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এসব করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ছিনতাইসহ নানান অপরাধেও অনেকে জড়িয়ে পড়ে।
ডিএমপির উত্তরা অপরাধ বিভাগের তথ্যানুসারে— তুরাগ থানা এলাকায় ‘পারভেজ গ্রুপ’, উত্তরখানে ‘রুস্তম গ্রুপ’ ও ‘নাইন এমএম বিগ বস’, দক্ষিণখানে ‘বিগবস’ ও ‘ইয়াং স্টার গ্রুপ’, উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় ‘নাইন স্টার গ্রুপ’ নামে অপরাধী চক্র রয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের নেতা ও সদস্যদের অপরাধ দমন ও গ্রেফতারের জন্য প্রতিটি মহানগর ও বিভাগে পৃথক তালিকা পাঠানো হয়েছে। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামে সবচেয়ে উৎপাত বেশি কিশোর গ্যাংয়ের। চট্টগ্রাম মহানগরে কিশোর অপরাধের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪০৩টি মামলা হয়েছে।
ঢাকায় ছিনতাই প্রতিরোধে ডিএমপির টাস্কফোর্স গঠন
ঢাকা মহানগরী ছিনতাইমুক্ত করতে নগরবাসীর নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিতকরণ এবং অপরাধ ভীতি দূর করতে ডিএমপির পক্ষ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ডিএমপি সদরদপ্তরের উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম বিভাগ) শচীন চাকমাকে সভাপতি করে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের অন্য সদস্যরা হলেন ডিএমপি সদরদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম-১) একজন, ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের আটজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, গোয়েন্দা পুলিশের আটজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার/সহকারী পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) একজন।
ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ঢাকায় কিশোর গ্যাং রোধে ডিএমপির ৫০টি থানা, ডিবির আটটি বিভাগ ও বিট পুলিশ কাজ করে। কয়েক দিন পরপরই কিশোর অপরাধের ঘটনা মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। তুচ্ছ ঘটনায় একে অপরকে খুন করছে। শুধু আইন প্রয়োগ করে কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। কিশোর অপরাধী এতটাই বেড়েছে যে ধরে ধরে সংশোধনাগারে পাঠালে সেখানেও জায়গায় হবে না। আমরা তালিকা তৈরি করে বিট পুলিশের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটর করি। কিশোর অপরাধীদের কাউন্সেলিং করে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়ানো। সন্তানরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশছে এসব বিষয় বাবা-মাকে দেখতে হবে সবার আগে। ঘর থেকে শিক্ষা দিলে সেই সন্তান বাইরে বেরিয়ে অপরাধে জড়াবে না।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৭ সালে আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং কালচার মানুষের সামনে আসে। তখনই প্রথম র্যাব কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যকে গ্রেফতার করে জনসম্মুখে আনে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ১১০০ সদস্যকে আইনের আওতায় এনেছে র্যাব। সারাদেশে কিশোর গ্যাং দমনে ও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যেসব আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের মদতদাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী বাহিনী সরব হচ্ছে। এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেবে র্যাব? এমন প্রশ্নে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ঢাকা উদ্যান, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরসহ র্যাব-২ এর এলাকায় গত চার মাসে এ ধরনের কিশোর গ্যাং বা যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিল তাদের প্রায় শতাধিকের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে যারা কিশোর গ্যাং গ্রুপ ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কিশোর গ্যাং দমনে ডিবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। যত বড় শক্তিশালী কিশোর গ্যাং থাকুক না কেন ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং হবে। এসব গ্যাংয়ের মদতদাতাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। মদতদাতারা যে দলেরই হোক আইনের আওতায় আনা হবে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুর থেকেও বেশ কয়েকজন কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচনের সঙ্গে পেশিশক্তির সম্পর্ক রয়েছে। নির্বাচনে যত বেশি পেশিশক্তি ব্যবহার হবে তত বেশি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে নির্বাচন দূরে সরে যাবে। অতীতে নির্বাচনেও দেখেছি, ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ, কোণঠাসা, ভোটের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে নানাভাবে অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। অগণতান্ত্রিক অবলম্বনে যেসব পন্থা নেওয়া হয় এর মধ্যে অন্যতম কিশোর অপরাধ। আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে শঙ্কা বা ভয়ের জায়গাটা কিশোর গ্যাং। এতে গণতান্ত্রিক ভাবধারা নষ্ট হতে পারে। সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলে অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচনে কেউ না কেউ কিশোর গ্যাং অপরাধীদের ব্যবহার করবে। এতে হামলা-মামলার ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটবে। এতে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় দায় রয়েছে। কারণ তারা এসব ঘটনা অনেক সময় নামকাওয়াস্তে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর পেছনে যে রাজনৈতিক ব্যক্তি থাকেন তারাও অনেক সময় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা না নেওয়া হয় সেজন্য চাপ প্রয়োগ করেন। সবকিছু মিলিয়ে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে যে বাধা তৈরি হতে পারে তার মধ্যে কিশোর গ্যাং।