দেশে একসময় আটা-ময়দাজাত পণ্যের চাহিদার প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করতো পাড়া-মহল্লার হস্তচালিত বেকারিগুলো। এখন এটা বড় বড় শিল্পগ্রুপের দখলে। নতুন করে আনাচে-কানাচের কনফেকশনারির দোকানগুলো হয়ে উঠছে একেকটি লাইভ বেকারি। এতে দুরবস্থায় পুরোনো বেকারিগুলো। রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। এসব নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে তৃতীয় ও শেষ পর্ব।
মোহাম্মদপুর বসিলার টিএইচ বেকারি। ছয়মাস আগেও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন ছাড়া পণ্য তৈরি করার অপরাধে জরিমানা গুনেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ৫ অক্টোবর ফের সেখানে অভিযান চালান বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ দফায়ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের খাবার তৈরি ও অনুমোদন ছাড়া পণ্য বিক্রির দায়ে দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানটি।
সবশেষ অভিযানে দেখা যায়, গতবার অভিযান ও জরিমানার পর উন্নতি তো হয়নি, বরং আগের চেয়ে বেকারিটির অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে। এবারও অনুমোদন না নিয়ে বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করছিল তারা। তারচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, প্রতিষ্ঠানটির খাবারে অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।
ওই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছিলেন বিএসটিআইয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কানিজ ফাতেমা লিজা। তিনি বলেন, ‘খাবার মুচমুচে ও সুস্বাদু করার জন্য এ রাসায়নিক ব্যবহার করেছিল ওই বেকারি। এছাড়া অনেক সময় বেকারিতে পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিন ব্যবহার করতে দেখি আমরা। যেসব রাসায়নিক মাত্রাতিরিক্ত হলে খুব ক্ষতিকর।’
এ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহারে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে সেটা জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্য পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক সমন্বয়) ড. সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রুটি, পাউরুটি ও বেকারি খাদ্যে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াম সালফেট, পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিন ব্যবহার করা হচ্ছে এটা সত্য, যা একটি বড় সমস্যা। খাদ্যে এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, ক্যানসার, জিনগত রোগ ও মিউটেশন, ডায়রিয়া, বমিভাব ও পেটের পীড়া তৈরি করতে পারে।’
সহদেব চন্দ্র বলেন, ‘এসব রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে ২০২১ সালে, যা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
জানা যায়, পাউরুটি ফোলানো, কৃত্রিম রং ও বিভিন্ন আকৃতি দিতে ট্রান্সফ্যাট ও মিষ্টিজাতীয় রাসায়নিক সোডিয়াম সাইক্রোমেট নামের উপাদান ব্যবহার করা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিনও ব্যবহার করা হচ্ছে। বেকারি শিল্পের লোকজনের কাছে এটি ‘ব্রেড এনহ্যান্সার’ নামে পরিচিত। সোডিয়াম সাইক্রোমেটের তুলনায় পটাশিয়াম কম দাম হওয়ায় খরচ বাঁচাতে এটা করা হচ্ছে। এছাড়া খাবার মুচমুচে ও সুস্বাদু করার জন্য ব্যবহার হয় সাল্টু বা অ্যামোনিয়াম।
সহদেব চন্দ্র বলেন, ‘আইন করে এসব নিষিদ্ধ করার আগে আমরা বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের উদ্যোগে একটি গবেষণা করেছিলাম। এতে পাউরুটিতে অনুমোদিত মাত্রার অনেক বেশি পরিমাণে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে- এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। সে সময় চারটি জেলা থেকে ২১টি পাউরুটির নমুনা পরীক্ষা করেন গবেষকরা। সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কেজিপ্রতি পাউরুটিতে পাঁচ মিলিগ্রাম মাত্রায় পটাশিয়াম ব্রোমেট ব্যবহারের অনুমতি দিলেও ৬৭ শতাংশ পাউরুটির নমুনায় তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘গত বছরও নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন এসব রাসায়নিক ব্যবহারের মাত্রা অনেকটা কমেছে। তবে এখনো নির্মূল হয়নি। ছোট ছোট বেকারিগুলো এমনটা বেশি করছে। আমরা চেষ্টা করছি এদের প্রতিরোধ করতে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বেকারি মালিক জানান, একসময় পাউরুটি ফোলাতে ও দীর্ঘসময় খামির সতেজ রাখতে খাবার সোডা ব্যবহার করা হতো। এখন পটাশিয়াম ব্যবহার হয়। এছাড়া সাল্টু এর স্বাদ বাড়ায়। কম দাম বলে এসব বেকারি মালিকদের খরচও কমায়।
তিনি বলেন, ‘অনেক বেকারিতে ব্রেড ইমপ্রুভার এনজাইম নামে কিছু উপাদান কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে রাসায়নিকও ব্যবহার হচ্ছে। যেগুলো কোনটি ক্ষতিকর ও কোনটি ভালো সেটা অধিকাংশের জানা নেই।’
বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিএসটিআই এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সংস্থা দুটির বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা হয় । তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন অনিয়ম ও সমস্যার কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, দেশের বেশিরভাগ বেকারি প্রচলিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। এর মধ্যে ছোট ছোট হস্তচালিত বেকারিগুলোর নিয়ম ভঙ্গের প্রবণতা খুব বেশি। অধিকাংশ ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের জরিমানা হচ্ছে।
তারা বলছেন, বেশিভাগ ক্ষেত্রে বেকারিগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া নিম্নমানের খাবার তৈরি বেকারিগুলোর একটি বড় সমস্য।
তারা এ-ও বলছেন, পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ বেকারি অনুমোদন না নিয়েই বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করছে। আবার কারও কারও অনুমোদন থাকলেও সেটি হালনাগাদ নয়। পাশাপাশি তারা পণ্য মোড়কজাতকরণ নিবন্ধন সনদ নেয় না। পণ্যের গায়ে থাকে না উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও মেয়াদোত্তীর্ণের সঠিক তারিখ।
বেকারিগুলো তাদের শ্রমিক, কর্মী ও কারখানার পরিচচ্ছন্নতা বিষয়ে একেবারে উদাসীন। খাবারে পোকামাকড়ের উপস্থিতি, উৎপাদিত পণ্য যত্রতত্র সংরক্ষণ, নিম্নমানের উপাদান-উপকরণ ব্যবহার করা, ফুড গ্রেডেড নয় এমন কালার ও ফ্লেভার ব্যবহার বেকারিগুলোর জন্য নিত্যনৈমিত্তিক অপরাধ।
তথ্য বলছে, দেশে দুই ধরনের বেকারি রয়েছে। একটি হস্তচালিত (হাতে তৈরি নন-ব্র্যান্ড) বেকারি। দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজার এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা হাতে তৈরি পণ্য দেশের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন। অন্য ধরনটি অটো ও সেমি-অটো বেকারি। দেশে ১০০টির মতো এ ধরনের বেকারি রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড়। এছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী আরও প্রায় ১৫টি কারখানা করেছে। যেগুলো এখন বেকারি ব্র্যান্ড।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুজামান বলেন, ‘স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য যারা তৈরি করছেন তাদের ক্ষেত্রে আমরা সমস্যা পাচ্ছি না। তবে হাতে তৈরি বেকারিগুলোর উন্নতি হচ্ছে খুব ধীরে। এখনো কিছু বেকারিতে পা দিয়ে খামির তৈরির মতো ঘটনা হচ্ছে, যদিও সেটা আগের তুলনায় কম।’
এসব বিষয়ে হাতে তৈরি বেকারি পণ্য উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ রুটি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক বলেন, ‘শুরু থেকে কিছু সমস্যা বেকারিতে ছিল। তবে এখন সেসব কাটিয়ে উঠছে। যারা ভালোভাবে নিয়ম-নীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তারাই টিকে থাকতে পারছে। সরকারের নানা সংস্থা এখন তদারকি করছে। এতে অবস্থা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।’