সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশিষ্ট আইনজীবী। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘বেলা’র নির্বাহী প্রধান। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ‘পরিবেশ পুরস্কার’ এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০০৯ সালে টাইম সাময়িকীর ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট’ খেতাব পান। ২০১২ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য। ২০২২ সালে তিনি আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কারে ভূষিত হন।
রাজধানী ঢাকার জীবনমান, উন্নয়ন ও পরিবেশ নিয়ে মুখোমুখি হন । দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টি হোক বা না হোক, কেউ কি আসলে এখানে বসবাস করতে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মনে করেন, আপনি ধানমন্ডি থেকে গুলশানে যাবেন, আপনার মিটিং টাইম দুপুর ১টায়। আপনাকে বেলা ১১টার আগেই রওয়ানা দিতে হবে। নইলে আপনি সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না। সময়ের কথা বাদ দেন। নিরাপদও বোধ করবেন না।
রাস্তায় বেরুলেই আওয়াজে আপনার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। অনেকেই তো আপনার-আমার মতো গ্লাস বন্ধ এসি গাড়িতে চলতে পারে না। একজন মা হেঁটে হেঁটে তার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যান। তার অবস্থার কথা চিন্তা করেন। গোটা পৃথিবীতে অবসবাসযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকা সাত নম্বরে । ‘যতই অবসবাসযোগ্য হোক না কেন, আমার নগরী তো আমার কাছে খুব প্রিয়। পৃথিবীর অনেক সুন্দর জায়গায় যাই। ঢাকায় ফিরে এলে আমার কাছে মনে হয় আমার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছি। আমার জায়গাটার করুণ মৃত্যু চোখের সামনে দেখছি। কিন্তু এটি নিয়ে কোথাও কোনো আওয়াজ নেই’
যতই অবসবাসযোগ্য হোক না কেন, আমার নগরী তো আমার কাছে খুব প্রিয়। পৃথিবীর অনেক সুন্দর জায়গায় যাই। ঢাকায় ফিরে এলে আমার কাছে মনে হয় আমার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছি। আমার জায়গাটার করুণ মৃত্যু চোখের সামনে দেখছি। কিন্তু এটি নিয়ে কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। ঢাকা কেন অবসবাসযোগ্য নগরী হয়ে উঠছে, তা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা করতে দেখি না। মন্ত্রী, এমপিরা কখনো আলোচনা করেন না। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।
ঢাকার বাতাস এত দূষিত যে আমাদের গড় আয়ু গড়ে আট বছর কমে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ বাস্তবতাকে আমরা কেবল দেখে যাচ্ছি, শুনে যাচ্ছি। কিন্তু মোকাবিলা করার কোনো ব্যবস্থা নেই।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: কাগজেই আটকা সেই বিধিমালা। আপনি দেখান যে, এই বিধিমালা অনুসারে একটি কাজ করা হয়েছে। নির্মাণকাজ, ইটভাটা থেকে যে দূষণ হচ্ছে সেটা থেকেও কি আমরা রেহাই পাবো না। বাকস্বাধীনতা না থাকলেও অন্তত দূষণ তো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কারণ এর প্রভাব তো সবার ওপরই পড়ছে।
ক’দিন আগে পেশাজীবীরা বললেন, একটি শহরে ১৫ শতাংশ জলাশয় দরকার পড়ে। রাজধানী ঢাকায় আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। সব জলাশয় ভরাট করার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। সরকার, ব্যক্তি এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই উৎসবে মত্ত। শুধুই আবাসন চাই। নিশ্বাস না নিলেও যেন তাদের চলবে।
প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকায় আমরা কেবল থাকবোই? আমাদের ড্রেনেজ লাগবে না? বেসরকারি আবাসিক প্রকল্প দেখেন, শুধু বালু ফেলে জায়গা দখল করে আছে। সেখানে কোনো নির্মাণকাজ নেই। রাজউকের পূর্বাচল, উত্তরা প্রকল্পে দেখেন, সব খালি প্লট পড়ে আছে। রাজউক সবচেয়ে বেশি জমি বিক্রি করছে পূর্বাচলে। কারা এখানে জমি কিনছে? অবশ্যই সাধারণ মানুষেরা নয়। একটি শহরের উন্নয়নের জন্য দর্শন থাকে। রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে কোনো দর্শন নেই। রাজধানীর ৩৯টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। এখানকার শিশুরা তাহলে কি করবে? মোবাইলে থাকলে আপনি বকা দিচ্ছেন। কোথায় যাবে ওরা?’
একটি শহরের উন্নয়নের জন্য দর্শন থাকে। রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে কোনো দর্শন নেই। রাজধানীর ৩৯টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। এখানকার শিশুরা তাহলে কি করবে? মোবাইলে থাকলে আপনি বকা দিচ্ছেন। কোথায় যাবে ওরা?
এই শহর যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত না। গোটা দেশ থেকে মানুষ নগরগুলোতে ভিড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষ শহরে আসছে। কারণ শহরের অর্থনীতি গ্রাম থেকে সচল। মানুষের চাপে সব তো শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা শহরে সাতটি নদী। অথচ পানি আনতে মেঘনা যেতে হচ্ছে। সব দূষিত করে ফেলেছি। বাতাস, পানি, কৃষিজমি দূষণ, জলাশয় ভরাট কী নেই আমাদের নগরীতে। বিলাসিতার কথা বাদ দিলাম। মানুষ তো একটু স্বস্তি চায়। আমরা কি সেটা দিতে পারছি?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: যা ভাবছেন, তার চেয়েও ভয়াবহ। গতবার বৃষ্টি কম হয়েছিল। নগরকর্তারা খুশি হয়ে গেলেন। তারা ক্রেডিট নিতে শুরু করলেন। বলতে থাকলেন, তারা কয়েকটি খাল মুক্ত করেছেন বলেই ঢাকা তলিয়ে যায়নি। তাহলে এবার মাত্র ছয় ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেলো কেন? সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় কোমর পর্যন্ত পানি!
নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ভূমিদস্যুদের সংযোগ আছে। এ কারণেই রাজধানীর করুণ মৃত্যু ঘটছে। এ শহরে মানুষ ম্যানহোলে পড়ে মারা যায়, পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়, চট্টগ্রামে খালের মধ্যে পড়ে শিশুরা মরছে। মানুষের এভাবে মরলেই তো একটি শহরের করুণ মৃত্যু হয়। গড়ে আট বছর আয়ু কমছে। প্রতি বছর দুই লাখ মানুষ বায়ুদূষণে মরছে। সঠিক ব্যবস্থা নিলে অন্তত এই মৃত্যুর হার তো কমে আসতে পারে।
সরকার ইচ্ছা করে পরিবেশ আর উন্নয়নকে মুখোমুখি করে দিচ্ছে। যেন উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের ধ্বংস করতে হবে। কোথায় বলা আছে, পরিবেশ নষ্ট করে উন্নয়ন করতে হবে? পরিবেশ ঠিক রেখে উন্নয়ন করা যায় না? জলাশয় ভরে উন্নয়ন করতে হবে কেন? কার আবাসন করার সুযোগ দিচ্ছে সরকার?