সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট পার্টির এক নেতার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়ে ঢাকার পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। গত শুক্রবার নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর রবার্ট মেনেনডেজের বিরুদ্ধে ১০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। সিএনএনের ২২ সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মেনেনডেজ এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে ‘লাখ লাখ ডলার ঘুষ’ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রসিকিউটারদের অভিযোগ অনুযায়ী, মেনেনডেজের নেওয়া ঘুষের মধ্যে সোনা, নগদ টাকা, বাড়ির মর্টগেজ বাবদ পাওয়া অর্থ রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহার করে গোপনে বিভিন্ন কার্যসাধনের জন্য নেওয়া ঘুষ এবং একটি বিলাসবহুল গাড়ি নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
ঢাকা কেন খুশি? কারণ মেনেনডেজ এবং রিপাবলিকান সিনেটর টড ইয়াংয়ের নেতৃত্বে তাদের আট সহযোগী সিনেটর বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলেন। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট র্যাব ও এর সাত বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তাকে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে’র অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমেরিকান থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর থেকেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগ তোলে। আটলান্টিক কাউন্সিলের অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০০৬ সালের ডিসেম্বর ও ২০০৯ সালের রিপোর্টে র্যাবের বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ‘নতুন ভিসানীতি’ ঘোষণার দুই বছর আগে এসব ঘটে। যেসব বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে এই নীতি প্রযোজ্য হবে বলে জানান। বার্তায় বলা হয়েছে, বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার ও বিরোধীপক্ষের নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর এ ভিসানীতি প্রযোজ্য হবে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও তোলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। (দ্য হিন্দু, ২ জুন)
যেসব কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে সেসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভোট কারচুপি, ভোটারদের প্রলুব্ধ করা, জনগণকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা, গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের মত প্রকাশে বাধা দেওয়া প্রভৃতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে এসব দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া দলটি স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে, তারা আসন্ন নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। ৩ আগস্ট দ্য প্রিন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অভিভাবক নয়। ‘বিশ্বকে বাঁচানো হলিউডের কল্পনা। ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’ নিছক কল্পকাহিনি। বাস্তবতা হলো, আমরা নিজেরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের দেখভাল করতে পারি। আমেরিকা এ বিষয়ে নছিয়ত না করলেও চলবে।
আমেরিকানদের কিছু উদ্বেগ হয়তো ভুল নয়। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার ৭ মে ২০২৩-এ লিখেছে, ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সংগ্রাম করছে। এটি এমন একটি চ্যালেঞ্জ যা সম্প্রতি আরও তীব্র হয়েছে। ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এ সময়ে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ ভিন্নমত দমন করার জন্য বিভিন্ন পন্থা ব্যবহার করেছে।’
ওয়াশিংটন কি সত্যিই চিন্তিত?
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ অনেকটা খরগোশের সঙ্গে দৌড়ানো এবং শিকারির সঙ্গে শিকার করার মতো ক্ল্যাসিক ঘটনা। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে দেশটি যদি সত্যিই উদ্বিগ্ন হতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি ঠেকাতে হাসিনাকে ফোন করতেন না। একটি দৈনিক এ সংবাদটি প্রকাশ করেছিল। কেরি হাসিনাকে বলেছিলেন, জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ডের কারণে সংসদ নির্বাচনকে বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতার পক্ষ নেওয়া আধুনিক জার্মানিতে নাৎসির নির্বাচনী অধিকারের পক্ষে ওকালতির মতো ঘটনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা ২ বছরের শিশুকে পিটিয়ে, এক গর্ভবতী নারীকে এবং দুই নাবালিকাকে গলা কেটে হত্যা করেছিল।
জামায়াতকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়ে দলটিকে বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই এই গোষ্ঠীর ‘বাক ও সমাবেশের সাংবিধানিক স্বাধীনতার’ পক্ষে কথা বলেছে। জামায়াত ইস্যুতে ওয়াশিংটনের অবস্থানের প্রতিবাদ করে বিশিষ্ট বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, গোষ্ঠীটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ এবং অন্যান্য ধরনের সহিংসতায় সহযোগিতা করেছিল এবং তারা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জন্মের পেছনে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা ছিল বেশ সন্দেহজনক। সাংবাদিক এবং অ্যাকাডেমিক গ্যারি জে. বাস দ্য ব্লাড ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেলের একটি মেমোর ওপর ভিত্তি করে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম- দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং ভুলে যাওয়া গণহত্যা। এই মেমোগুলোতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন নীতির কথা উঠে এসেছে। বইতে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের কথা উঠে এসেছে। যে দেশটি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মানুষের ওপর নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছিল।
এসব ৫২ বছর আগের কথা। আজকের বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত- ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতির ওপর ভিত্তি করে তার পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। উপরে যতই মধুর দেখাক না কেন, বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহাসিকভাবে বিদ্বেষ পোষণ করে। মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক যখন বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয় তখন চীন এটি নির্মাণে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই আনন্দিত হয়নি। এ ছাড়া মোদি-হাসিনার সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখছে তাও বিতর্কের বিষয়।
এমন হতেই পারে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কড়া নজরদারি প্রয়োজন। তবে এ কাজটি দেশটির নিজেকেই করতে হবে। তবে একটি কথা পরিষ্কার, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটি ওয়াশিংটনের কাছ থেকে নির্দেশনা নিতে চায় না এবং তাদের পুতুলও হতে চায় না। দ্রুত পরিবর্তনশীল, বহুমাত্রিক একটি দেশের ক্যাপ্টেন আমেরিকার প্রয়োজন নেই। মার্ভেল স্টুডিওর জন্যই এই কল্পকাহিনি ঠিক আছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য নয়।