ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের মনিটরিংয়ের পরও লাগাম টানা যাচ্ছে না আলুর দামে। এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। অর্থাৎ ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ৫শ টাকা। পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও ঠিক কী কারণে এভাবে হু হু করে আলুর দাম বাড়ছে তার সঠিক ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই।

অভিযোগ রয়েছে, মধ্যস্বত্বভোগী আর সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে হিমাগার থেকে পর্যাপ্ত আলু বাজারে সরবরাহ না করে সংকট দেখানো হচ্ছে। আর এভাবেই বাড়ানো হচ্ছে দাম। এতে অধিক মুনাফায় পকেট ভারী হচ্ছে ব্যবসায়ীদের, বিপাকে পড়ছেন ভোক্তারা।

সরেজমিনে মুন্সিগঞ্জের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। পাইকারি বাজারে তা ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। গত মাসে খুচরা বাজারে দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা আর পাইকারিতে ছিল ২৭ থেকে ২৮ টাকা।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এবছর মুন্সিগঞ্জে হেক্টরপ্রতি আলু উৎপাদনে গড়ে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন বা ৩০ হাজার ৭৫০ কেজি। অর্থাৎ মাঠে এবছর আলুর কেজিপ্রতি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা। পরিবহন ও হিমাগারে সংরক্ষণের খরচ মিলিয়ে প্রতিকেজি আলুতে পড়ে ১৬ থেকে ১৭ টাকা। কিন্তু এই আলু বাজারে গেলে ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে।

মৌসুমের শুরুতে কৃষকদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা এবার ৫০ কেজির প্রতিবস্তা আলু ৭শ থেকে ৭শ ৫০ টাকায় কিনেছিলেন। সেসব আলুর বস্তা এখন বিক্রি করছে ১৯শ থেকে ১৯শ ৫০ টাকায়। হিমাগার খরচ বাদে তাদের প্রতিবস্তায় লাভ থাকছে ৯শ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ, কেউ যদি এক হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেন তবে বর্তমান বাজারে বিক্রিতে তার লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ লাখ। আর ১০ হাজার বস্তা সংরক্ষণ করে থাকলে লাভের অঙ্কটা কোটির ঘরে। ভোক্তারা বলছেন, লাভের এমন প্রেক্ষাপট বলে দেয় ব্যবসায়ীদের হাতে থাকা আলু এখন রীতিমতো আলাদিনের চেরাগ।

ব্যবসায়ীরা সংকটের কথা বললেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে মুন্সিগঞ্জে ১০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়। এখনো জেলার হিমাগারগুলোতে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন আলু মজুত রয়েছে। যার মধ্যে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৮০ মেট্রিক টন খাবার আলু। আর ৭৭ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন বীজ আলু। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে জেলার হিমাগার থেকে বাজারজাত করা হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন আলু।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ বি এম ওয়াহিদুর রহমান  বলেন, জেলায় চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে। সংকটের অজুহাতে দামবৃদ্ধি অযৌক্তিক। ৯০ শতাংশ কৃষক ব্যবসায়ীদের কাছে আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীরা কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে এটা স্পষ্ট। নয়তো এত দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।

বিষয়টির সত্যতা জানতে কথা হয় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে কৃষকদের হাতে আর বেশি আলু নেই। কোনো হিমাগারে যদি দুই লাখ বস্তা আলু থাকে তবে ২০ হাজার বস্তা কৃষকদের আর বাকি সব ব্যাপারীদের। আগে যেভাবে হিমাগার থেকে আলু বাজারজাত করা হতো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তা এখন ভিন্নভাবে হচ্ছে। আগে ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে যে যার ইচ্ছামতো আলু বাজারজাত করতেন। এখন নিয়ম করে পর্যায়ক্রমে সেটি করা হচ্ছে। আগে যেখানে একটি হিমাগার থেকে প্রতিদিন চার ব্যবসায়ীর চার ট্রাক আলু বাজারে যেত সেখানে এখন দুই ব্যবসায়ীর দুই ট্রাক বাজারে যায়। ফলে বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে।

সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটের পাশাপাশি দামবৃদ্ধির আরেক কারণ হলো হাতবদল। হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণে রেখেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেনাবেচা চলতে থাকে। এতে প্রতি হাত বদলেই দাম বেড়ে যায়। ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে যতবার হাতবদল হয় দাম তত বাড়ে।

জেলা সদরের এক আলু ব্যবসায়ী জানান, মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন মোকামে আলু যায়। এর একটি বড় অংশ যায় চট্টগ্রামে। সেখান থেকেই মূলত দাম নির্ধারণ হয়। তিনি জানান, সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) এক হাজার বস্তা আলু বিক্রি করেছেন ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। খরচ বাদে তার লাভ হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ টাকা।

মুন্সিগঞ্জ প্রধান বাজারের দোকানদার মো. হাবিব বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে কিনে কিছুটা লাভে খুচরা বাজারে বিক্রি করি। গত মাসের চেয়ে পাইকারি বাজারে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা দাম বেড়েছে। তাই খুচরা বাজারেও দাম বেশি। একই দাবি, ওই বাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ীর। তারা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের সঙ্গে আলুর দামের যোগসূত্র রয়েছে।

যা বলছেন ক্রেতারা

মুন্সিগঞ্জ প্রধান বাজারের কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সুমন ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, একসময় চালের দামবৃদ্ধির কারণে মানুষ আলু কুচি করে চালের সঙ্গে দিয়ে খেতো। এখন আলুর দাম বেড়েই চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো আঙুল ফুলে কলা গাছ হবে ব্যবসায়ীরা। আর আমাদের মাথায় হাত।

আরেক ক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, টিভি চ্যানেলে দেখি দেশে আলুর সংকট নেই, তারপরেও কেন দাম বেশি? মুন্সিগঞ্জে তো অন্তত দাম বেশি হওয়ার কথা নয়। আমাদের প্রতিটা কোল্ড স্টোরেজে হাজার হাজার বস্তা আলু। সব ব্যবসায়ীদের কারসাজি। কয়দিন পরপর এটা ওইটার দাম বাড়ায়।

সরকারিভাবে আলুর দাম নির্ধারণের দাবি জানিয়ে হুমায়ন কবির নামে এক ক্রেতা বলেন, ব্যবসায়ীরা তো চাইবেই দাম বাড়াতে। সরকারিভাবে যদি দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তবেই কেবল আমরা ন্যায্য দামে আলু খেতে পারবো। আলুর সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। নয়তো দাম বাড়তে বাড়তে একসময় কেনার সামর্থ্য থাকবে না।

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম  বলেন, আমরা মনিটরিং করছি। বাজারে যেন সরবরাহ ঠিক থাকে সেটি দেখে অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আলুর দাম নির্ধারণ না থাকায় কে কত দামে ক্রয়-বিক্রয় করবে তার ওপর কোনো আইন আরোপ নেই। তবে রশিদ ছাড়া কেউ আলু ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না। ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক বলেন, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি এসেছে। সেখানে জেলা কৃষি বিপণন কমিটির মাধ্যমে একটা মিটিং করার জন্য নির্দেশনা ছিল। গত ৩০ আগস্ট সে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন যেহেতু কৃষকদের হাতে আলু নেই তাই হিমাগারে ব্যবসায়ীদের হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি হিমাগারের ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হবে এবং কোন ফড়িয়ার কতটুকু আলু আছে তা বের করা হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য সবাই সমন্বয় করে হিমাগারগুলোতে মনিটরিং করা হচ্ছে। সেখান থেকে সঠিকভাবে আলু বাজারজাত হচ্ছে কি না, কিংবা কোনো কারণে আটকে রেখে বাজারে ঘাটতি সৃষ্টি করছে কি না তা মনিটরিং করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে আলুর দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। হিমাগারে হাতবদলের মধ্যমেই দাম বেড়ে যাচ্ছে। আলুর যে দাম সেটি যদি কৃষক পেতো তাহলে ঠিক ছিল, অত্যধিক মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কীভাবে কমানো যায় সেটিই এখন নজর রাখা হচ্ছে।