নীলফামারীর নীলকুঞ্জ আবাসিক এলাকার ‘খালিদ ছাত্রাবাস’। সেখানে বর্তমানে রয়েছেন ৩৫ শিক্ষার্থী। সোমবার (২১ আগস্ট) এ ৩৫ শিক্ষার্থীর জন্য বাজার করা হয় এক হাজার ৮০ টাকার। এ বাজারে দুপুরে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য বরাদ্দ একপিস ব্রয়লার মাংস ও আলু, সঙ্গে ঢ্যাঁড়শ ভাজি। রাতের মেন্যুতে রয়েছে আলু ও বেগুনের সবজি, সঙ্গে শাক ভাজি।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ছাত্রাবাসগুলোতে নিত্যদিনের খাবারের তালিকা থেকে অনেক আগেই বাদ পড়েছে গরুর মাংস, রুই মাছ, কাতলা মাছসহ পুষ্টি ও আমিষযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ খাবার। ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার কারণে কোনো কোনো মেসে সেটিও জোটে না। এ অবস্থায় ভরসা ছিল ডিম। তবে সম্প্রতি ডিমের দামও বেড়ে যাওয়ায় তা উঠে যাচ্ছে মেসের খাদ্যতালিকা থেকে।
জেলা শহরের ছাত্রীনিবাসগুলোর অবস্থা আরও করুণ। সাকিব ছাত্রীনিবাস, মীম ছাত্রীনিবাস, নিঝুম প্যালেসসহ বেশ কয়েকটি ছাত্রীনিবাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিন আগেও ২৫ টাকা করে মিল চার্জ দিয়ে দুপুরের একটি ডিম দুজন ভাগ করে ও রাতে শুধু সবজি দিয়েই খেয়েছেন তারা। বর্তমানে ডিম উঠে গেছে খাদ্যতালিকা থেকে। আর মেন্যুতে যেদিন ব্রয়লার মাংস থাকে সেদিন সবজির পরিমাণ কম পান শিক্ষার্থীরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক কম পরিশ্রমী পুরুষের দৈনিক গড়ে ২১০০-২৪০০ কিলো ক্যালরি পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন। তবে খালিদ ছাত্রাবাসের বরাদ্দ এ খাবার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একেকজন শিক্ষার্থী ৪২০ কিলো ক্যালরি পুষ্টিও পাচ্ছেন না। পুষ্টি চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগও পূরণ হচ্ছে না তাদের।
শুধু খালিদ ছাত্রাবাস নয়; জেলা শহরের মিতি তাছিন, মহসিন, নিশি নিতু, জগদিশ ছাত্রাবাসসহ প্রায় শতাধিক ছাত্রাবাসের চিত্র একই রকম।
খালিদ ছাত্রাবাসের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শাহিন আলম বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে আমরা দুপুরে শুধু এক টুকরা ব্রয়লার মাংস খেয়েছি। ডিম খাইনি প্রায় দুই সপ্তাহ। কারণ ডিম কিনলে অন্যান্য জিনিস কেনা অসম্ভব হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘মেসে খাবারের যে মান, আমরা যা খাচ্ছি তাতে অনেকের শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এমন হলে মেসে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে।’
মহসিন ছাত্রাবাসের মনিটর নুর আলম বলেন, ‘খাবার দেখলে কান্না পায়। ৩৫ টাকা মিল চার্জ দিয়েও কোনোবেলা ভালো খেতে পারি না। ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ায় ডিম খেতাম কিছুদিন আগে। এখন তো ডিমের দামও বেশি।’
সাকিব ছাত্রীনিবাসে থাকেন মেঘলা তাসনিম। তিনি বলেন, ‘গত তিনদিনের চিত্র যদি বলি দুপুরে একদিন শুধু ব্রয়লার মাংস খেয়েছি। বাকি দুদিন সবজি আর শাক। রাতে তো ডাল-ভর্তা। সকালে পাতলা ডাল ও আলুভর্তা খেয়েছি। আমরা নিরুপায়। কারণ পরিবার থেকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে এসব খেতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে অনেক কষ্টে আছি আমরা।’
নীলফামারী সরকারি কলেজ ছাত্রীনিবাসের মাইশা পপি বলেন, ‘এখানে আমরা প্রায় ২০০ জন আছি। বেশিরভাগ দিন ডিম খেতে হয়। কারণ মেয়েদের অনেকেই ব্রয়লার পছন্দ করে না। ডিম খেলেও এখন পুরো ডিম খেতে পাই না। অর্ধেক করে খেতে হচ্ছে। ভাজি খেতে খেতে অবস্থা শেষ। ইচ্ছা হয় রসালো খাবার খেতে কিন্তু বাজারের যে অবস্থা তাতে সাধ আটকে যায় সাধ্যের কাছে।’
এ বিষয়ে কথা হয় নীলফামারী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯-৩০ বছর বয়সী কম পরিশ্রমী একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ২১০০-২৪০০ কিলো ক্যালরি পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন। যেহেতু এ ক্যালরির তিন ভাগের এক ভাগও পাচ্ছেন না মেসের শিক্ষার্থীরা, এতে প্রোটিনের বড় ধরনের ঘাটতি হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের ঘাটতি হতে পারে। এতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু সমস্যায় পড়তে পারেন শিক্ষার্থীরা।
আরএমও বলেন, ভিটামিন সি’র অভাবে ত্বকে অ্যালার্জি, অপুষ্টিজনিত কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
পুষ্টি চাহিদা পূরণের বিকল্প কোনো উপায় আছে কি না জানতে চাইলে এ চিকিৎসক বলেন, যেহেতু মাছ-মাংসের দাম বেশি সেহেতু প্রতিদিন এগুলো তালিকায় না রেখে শাকসবজির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া বেশি পরিমাণে ডাল, সম্ভব হলে শিক্ষার্থীরা সমষ্টিগতভাবে মৌসুমি ফল খেতে পারেন। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে পুষ্টি সচেতনতা।