দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজার। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতসহ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সড়ক, নৌ, বিমানপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলেও এতদিন রেলপথে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। তবে বর্তমান সরকার পর্যটন নগরীকে রেলওয়ে যোগাযোগের আওতায় নিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হবে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরেই চালু হবে ঢাকা-কক্সবাজার রেল চলাচল। আর এর মাধ্যমেই খুলতে যাচ্ছে রেলের দক্ষিণের দুয়ার। এতে কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যেমন যোগ হবে, আবার ট্রেনে বসেই যাত্রীরা শুনতে পারবে সমুদ্রের উত্তাল গর্জন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১০ সালে এই কাজ শুরু হয়, শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই পথে রেলস্টেশন থাকছে ৯টি। পুরো প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজায় নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেলস্টেশন। সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক স্থাপন ও স্টেশনের কাজ এরই মধ্যে ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, এর ফলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে। পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা যাবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার সদরের ঝিলংজায় ২০ একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে ঝিনুকের আদলে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। শতাধিক শ্রমিক-কর্মকর্তা এখন পুরো রেলস্টেশনজুড়ে করছেন নানা ধরনের কাজ। স্টেশনের প্রবেশমুখে একপাশে গাড়ি রাখার স্থান প্রস্তুতসহ নানা অবকাঠামোর কাজ চলছে। স্টেশনের তিনটি প্ল্যাটফর্মে ছয়টি রেললাইনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলছে স্টেশনের মূল ভবনের কাজও। ছয়তলা ভবনের নিচ তলায় যাত্রীদের টিকিট কাটার ব্যবস্থা থাকবে, অন্য তলায় থাকবে যাত্রীদের জন্য নানা সুবিধা। এছাড়া ক্যান্টিন, হোটেল, মার্কেটসহ ৫ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার কনভেনশন সেন্টার থাকবে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে।
পর্যটকরা যেন স্বাচ্ছন্দে কেনাকাটা করতে পারেন সেজন্য মার্কেট স্থাপন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে এসে ঘোরাঘুরি শেষে দিনে দিনেই ফিরতে চাইলে নিজেদের জিনিসপত্র যেন রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে থাকবে পাঁচ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার কনভেনশন সেন্টার। সেখানে কক্সবাজারসহ যেকোনো এলাকার মানুষ কনফারেন্স বা যেকোনো অনুষ্ঠান করতে পারবে।
এরই মধ্যে আইকনিক স্টেশনের ৮০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজও চলছে পুরোদমে। নান্দনিক সৌন্দর্যের এই স্টেশনে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন মো. রাসেল মিয়া। তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে টানা কাজ করছি। খুব দ্রুত কাজ চলছে। স্টেশনের কাজ শেষ হলে পর্যটকদের বেশ আকৃষ্ট করবে।
চলতি বছরেই ঢাকা থেকে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এর মধ্যদিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি হবে নতুন মাত্রা। সড়ক পথের দীর্ঘ যাত্রার ভোগান্তি ছাড়াই পর্যটকরা এখন সহজেই ছুঁয়ে দেখতে পারবেন সমুদ্রের নীলজল।
জানা গেছে, আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল হতে পারে। সড়কপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসতে যেখানে সময় লাগে প্রায় সাড়ে ১১ ঘণ্টা, ট্রেনে আসতে সেখানে লাগবে মাত্র সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। কমে আসবে পরিবহন ব্যয়ও। ঢাকা থেকে এসি বাসে যেখানে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে ট্রেনের এসি চেয়ারে বসে কক্সবাজার আসতে লাগবে মাত্র এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। নন-এসি চেয়ার কোচে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হতে পারে। প্রাথমিকভাবে দুই জোড়া ট্রেন চলবে এই রুটে। পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন এখন চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসে, সেইসব ট্রেনের শেষ গন্তব্য হবে কক্সবাজার। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি ট্রেন চালু হবে এই রুটে। তবে এখনো ট্রেনের নাম নির্ধারণ করা হয়নি।
খুশি স্থানীয় বাসিন্দা-ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা
ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা। কক্সবাজার থেকে ঢাকা যেতে বাস কিংবা চট্টগ্রামে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হয় এখন। এতে সড়ক পথে যানজট বা ভ্রমণ করতে সমস্যা যেমন হয়, আবার সময়ও লাগে বেশি। ব্যবসায়ীদেরও সড়ক বা নৌপথে পণ্য পরিবহন করতে হয়। এতে অনেক সময় নানা সমস্যায় পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। রেল চলাচল শুরু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহন করতে পারবেন কক্সবাজারের ব্যবসায়ীরা।
ঝিলংজা স্টেশন এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল মিয়া বলেন, বাড়ির কাছেই আসবে চট্টগ্রাম বা ঢাকা যাওয়ার ট্রেন। ফলে সকালে বা রাতে যেকোনো সময় টিকিট কেটেই কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়া চট্টগ্রাম বা ঢাকায় চলে যেতে পারবো।
রেলস্টেশনের সামনে কথা হয় স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মাজহার আলীর সঙ্গে। মাজহার বলেন, সরকারের খুব ভালো একটি কাজ এটা। খুব সুন্দর করে রেলস্টেশন করছে সরকার। এখন সহজেই মানুষ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখতে আসতে পারবে। রেলপথ পেয়ে আমরাও খুশি।
স্থানীয় গ্যালাক্সি হোটেলের মালিক মো. মনির হোসেন বলেন, ট্রেন চলাচল শুরু হলে পর্যটকরা সহজেই কক্সবাজারে আসতে পারবে। এতে পর্যটক আরও বাড়তে পারে। এড়াছা অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজে ও পণ্য পরিবহনে আগের তুলনায় অনেকটাই সহজ হবে রেলপথ চালু হলে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসা পর্যটকরাও বলছেন, সড়ক পথে ভ্রমণ কিংবা সড়কে যানজটের ফলে ভোগান্তি এড়িয়ে অনেকেই রেলপথে সহজেই পর্যটন নগরী কক্সবাজারে আসতে পারবেন। সমুদ্রের নীলজল দেখে মানসিক প্রশান্তি নিয়ে দুর্ভোগ এড়িয়ে মানুষ ফিরতে পারবে নিজ গন্তব্যে।
কক্সবাজার ঘুরতে আসা ফয়সাল আহমেদ বলেন, ঢাকা থেকে বাসে এসেছি। ১৪ ঘণ্টা লেগেছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসতে। অনেক কষ্ট হয়েছে। বিমানে আসলে হয়তো ভোগান্তি এড়িয়ে আসা যেতো, কিন্তু ব্যয় বেশি হতো। তবে ট্রেন চলাচল শুরু হলে অনেক সহজে এবং স্বাচ্ছন্দে কক্সবাজার আসতে পারবেন পর্যটকরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের ফলে বদলে যাবে কক্সবাজারের দৃশ্যপট। এই অঞ্চলসহ দেশের পর্যটনেও যোগ হবে নতুন দিগন্ত। অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে আরও দ্রুত। ঢাকার সঙ্গে ট্রেনের যোগাযোগ ও দৃষ্টিনন্দন রেলস্টেশন নিয়ে উচ্ছ্বসিত তারা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারকে সিঙ্গাপুর বা উন্নত বিশ্বের পর্যটন নগরীর আদলে তৈরি করতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান সরকার। বিভিন্ন প্রকল্পে পুরো কক্সবাজারজুড়ে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার কাজ চলছে। ট্রেন চলাচল শুরু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ পর্যটনে যোগ হবে নতুন সম্ভাবনা।
দেশের সর্বদক্ষিণের জেলায় রেলপথ চালুর বিষয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে রেলপথ চালু হলে এটি যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। এর মাধ্যমে সহজেই স্থানীয়রা কক্সবাজার থেকে সরাসরি ঢাকায় যেতে পারবেন।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, এ প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, সামান্য কিছু বাকি আছে। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে চট্টগ্রাম তথা ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রায়াল ট্রেন চলবে। তবে সেপ্টেম্বরে ট্রায়াল ট্রেন চললেও বাণিজ্যিকভাবে যেতে আরও দুই-তিন মাস লাগবে। চলতি বছরের শেষ দিকে এই রেলপথে আমরা ট্রেন চালুর চেষ্টা করবো।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কক্সবাজারে রেলপথ চালু হলে এর মাধ্যমে এশিয়ান কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই বর্তমান সরকার এখানে নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা প্রকাশ পায়।