বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য (লাইফ) কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে ঘুস দাবির অভিযোগ উঠেছে। এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। সম্প্রতি লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেছেন প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তা জহির উদ্দিন।

অভিযোগপত্রে জহির উদ্দিন নিজেকে কোম্পানিটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিব এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বলে উল্লেখ করেছেন। ঘুসের টাকা না দেওয়ায় আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে অসত্য তথ্য দিয়ে তাকে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীসহ কোম্পানির একাধিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার চিঠি ইস্যু করানো হয়েছে বলেও অভিযোগ জহির উদ্দিনের।

তবে জহির উদ্দিনের করা অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করছেন আইডিআরএ সদস্য কামরুল হাসান। তার দাবি, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা তার নেই। আইডিআরএ’র একটা বোর্ড আছে। সেই বোর্ডের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আইডিআরএ’র সিদ্ধান্ত মনমতো না হওয়ায় জহির উদ্দিন এমন অভিযোগ করেছেন। আমি কোনো টাকা চাইনি। এটা ওরা নিজেরা নিজেরাই বানিয়েছে।

অপরদিকে জহির উদ্দিন দাবি করেছেন, আইডিআরএ’র সদস্য কামরুল হাসান তার কাছে যে ঘুস চেয়েছেন, এর সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ তার কাছে রয়েছে। তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছেন।

গত ১২ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর করা লিখিত অভিযোগে জহির উদ্দিন উল্লেখ করেছেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (লাইফ) কামরুল হাসান ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট জহির উদ্দিনকে তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। প্রগ্রেসিভ লাইফের সাবেক একজন মাঠকর্মীর মাধ্যমে তাকে সেখানে ডাকা হয়।

জহির উদ্দিন সেখানে উপস্থিত হলে আইডিআরএ’র সদস্য কামরুল হাসান তাকে এমডি (মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা) করার প্রস্তাব দেন। আর এজন্য তিনি জহির উদ্দিনের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। এছাড়া প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিমা দাবি পরিশোধে কামরুল হাসানকে নিয়ে মিটিং করে প্রতিটি মিটিংয়ে তাকে দুই লাখ টাকা করে সম্মানি দিতে বলেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে দাখিল করা ১০ পাতার অভিযোগ পত্রের ১০ ও ১১ নম্বর পয়েন্টে আইডিআরএ সদস্য কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে এ ঘুস চাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন জহির উদ্দিন।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তাবলেন, আইডিআরএ সদস্য কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে প্রগ্রেসিভ লাইফের জহির উদ্দিনের করা একটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের দেওয়া হবে।

জহির উদ্দিন জানান, ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট প্রগ্রেসিভ লাইফের সাবেক একজন মাঠ নির্বাহীর মাধ্যমে আইডিআরএ সদস্য তাকে ডেকে পাঠান। ওই ব্যক্তির সঙ্গে তিনি আইডিআরএ সদস্যের কক্ষে যান। ওই মাঠ নির্বাহীর সামনে কামরুল হাসান বলেন, তোমার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন চেয়ারম্যান। তোমার বিষয়টি চেয়ারম্যান নিজে দেখছেন, মন্ত্রণালয় থেকে দেখছে। এটা আমার হাতে নেই, ওপরে চলে গেছে। তালুকদারের সঙ্গে আমি ন্যাশনাল লাইফে চাকরি করেছিলাম, তালুকদার তোমাকে ইন্স্যুরেন্স ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করে দিতে বলেছে। তোমার অনেক শত্রু, তুমি এখানে এলে শুধু আমার সঙ্গে দেখা করবা, অন্য কারও সঙ্গে নয়। হুমায়ুন তোমাকে ভালো ও দক্ষ বলেছে। তাই তোমাকে আমি তার মাধ্যমে ডেকেছি। তুমি আমাকে প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা করে দেবে, আমি তোমাকে এমডি বানিয়ে দেবো।

জহির উদ্দিন আরও বলেন, আমি তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাকে প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল তিনি কোনো বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব নন এবং আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত। তা প্রকাশ হতে সময় লাগবে। এর মধ্যে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো এবং পরিবার নিয়ে বিপদে পড়বো।

‘সব ভেবে আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি সততার সঙ্গে আইন, বিধি, পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত চন্দ্র আইচের আইনানুগ নির্দেশে গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে কাজ করেছি। নিরলসভাবে করছি বলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে। আমি তো সিইও নই। আমাকে কেন কর্তৃপক্ষ এভাবে হয়রানি করবে। কাজ করলে আলোচনা বা সমালোচনা হতে পারে, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে তদন্ত করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছে।

জহির উদ্দিনের অভিযোগ, কামরুল হাসান তাকে বলেন- চেয়ারম্যানের সই করা নোট আমি ধরে রেখেছি, ছিঁড়ে ফেলবো। এটা বলার পর তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারী আশিফুলকে তার কক্ষে নথি আনতে বলেন এবং তার কাছে রাখেন। আমাকে ও তার পূর্ব পরিচিত মাঠ কর্মকর্তাকে দেখান এবং বলতে থাকেন, ‘আমার স্ত্রী ও মেয়ে আমেরিকা থাকে, তাদের টাকা পাঠাতে হয়। আমি খুব কম বেতন পাই, আমার চলে না। গাড়ির ২০০ লিটার জ্বালানি সরকার দেয়, তাতে চলে না। গুলশান যেতে আসতে শেষ হয়ে যায়। প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা এবং আমাকে নিয়ে বিমা দাবি পরিশোধে মিটিং করে প্রতিটি মিটিংয়ে দুই লাখ করে সম্মানি দেবে।

গত ২৫ জুন এক চিঠিতে প্রগ্রেসিভ লাইফের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী পদে জহির উদ্দিনের দায়িত্ব পালন বেআইনি ঘোষণা করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একই সঙ্গে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদের ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। চিঠিতে সই করেন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (আইন) মো. আব্দুল মজিদ।

চিঠিতে আরও বলা হয়, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন না থাকায় জহির উদ্দিনের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন করার আইনানুগ কোনো সুযোগ নেই।

এদিনই জহির উদ্দিনকে কোম্পানি সেক্রেটারি ছাড়া অন্য সব পদ থেকে অব্যাহতির নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। এই নির্দেশ বাস্তবায়নে বিমা কোম্পানিটিকে তিন কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়।

জহির উদ্দিন প্রগ্রেসিভ লাইফের আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। পরবর্তীসময়ে তিনি বিমা কোম্পানিটির একাধারে পাঁচটি বিভাগের দায়িত্ব নেন। এসব পদের মধ্যে রয়েছে- কোম্পানি সেক্রেটারি (সিএস), হেড অব এইচআরডি, হেড অব লিগ্যাল, হেড অব অ্যাডমিন এবং হেড অব এজেন্সি।

সবশেষ গত ১৮ জুন প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব নেন জহির উদ্দিন। বোর্ডসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিচালক রেজ্যুলেশন বাই সার্কুলেশনের মাধ্যমে তাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে দাবি জহির উদ্দিনের।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জহির উদ্দিন বলেন, আমি বিমা খাতে প্রায় ৩১ বছর আছি। অনেক শ্রম, ঘাম, মেধা দিয়ে আমি আজকের এ অবস্থায় আসছি। উনি (কামরুল হাসান) ঈদের আগে গত ১১ জুন আমাকে ডেকে টাকা দাবি করেছেন, না হলে আমাকে প্রগ্রেসিভ থেকে বের করে দেবেন। আমি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে তিনটি আবেদন করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।

তিনি বলেন, ওনার (কামরুল হাসান) অফিসে আমাকে সরাসরি অসংখ্যবার ডেকেছেন। উনি আমার কাছে বিভিন্ন সময় টাকা চেয়েছেন, সেটা আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। উনি আমার কাছে টাকা চেয়েছেন, সে রকম তথ্য-প্রমাণ আমার কাছে আছে।

এ বিষয়ে আইডিআরএ সদস্য কামরুল হাসান বলেন, আমরা একা সিদ্ধান্ত নেই না। এখানে একটা বোর্ড আছে। আমি একজন সদস্য, আর তিনজন সদস্য আছেন। চেয়ারম্যান আছেন। ৮-৯ জন মিলে একটা বোর্ড হয়। যে কোনো সিদ্ধান্ত বোর্ডের মাধ্যমে হয়। বোর্ড যখন সিদ্ধান্ত দেয়, অনেক সময় দেখা যায় যে মানুষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় সেটা তার জন্য পছন্দ নাও হতে পারে। যখন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন ওরা উল্টাপাল্টা কথা লেখে। আমি কোনো টাকা চাইনি। এটা ওরা নিজেরাই বানিয়েছে।

আপনি বলছেন আইডিআরএ’র সিদ্ধান্ত বোর্ডের মাধ্যমে হয়, তাহলে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে আপনার বিরুদ্ধে কেন এমন অভিযোগ করা হলো? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ওই যে আমি লাইফ সদস্য। প্রগ্রেসিভ লাইফের ওরা ভাবছে আমি লাইফ সদস্য। আমার চেয়ার এনাফ। কিন্তু ওরা বোঝে না আমার কোনো পাওয়ার নেই। আমি একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। এ ধরনের কোনো বিষয় আমার কাছে আসেনি। আমি এমন কোনো অভিযোগ পাইনি।