বাণিজ্যক্ষেত্রে বৈশ্বিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম মার্কিন মুদ্রা ডলার। বিশ্বের প্রায় সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় ডলারেই। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের পর থেকে দেশে ডলার সংকট চরমে। ক্রমে কমছে রিজার্ভ। তবে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছে রুপি। ভারতের সঙ্গে এখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে রুপি ব্যবহার করা যাবে। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) থেকে চালু হচ্ছে এ কার্যক্রম।
রুপিতে বাণিজ্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় যাবে। একই সঙ্গে ভারতেও বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার প্রচলনের কথা বলছেন তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এর মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে খরচও কমে আসবে। ডলারও সাশ্রয় হবে।
মঙ্গলবার (১১ জুলাই) রুপিতে লেনদেন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে। অবশ্য ভারত ডলারের পাশাপাশি রুপিতে অনেক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালু রয়েছে আগে থেকেই। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথমবারের মতো শুরু হচ্ছে এ প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ইস্টার্ন ব্যাংক রুপি লেনদেনে বিশেষ (ভস্ট্রো) অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকও অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। আমদানি-রপ্তানির বড় ধরনের গ্যাপ হলেও এতে বিপুল পরিমাণ ডলারের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে দেশে ডলার সংকট চলছে। এ সংকট কাটাতে জরুরি আমদানির জন্য প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবুও সংকট কাটার পরিবর্তে আরও বাড়ছে। সোমবার (১০ জুলাই) দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। রোববার যেটা ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ছিল। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আর এভাবে ডলার বিক্রির ফলে ৪৮ বিলিয়নের রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়নের ঘরে।
ভ্রমণ, চিকিৎসা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করেন। রুপিতে লেনদেন হলে এখানেও ডলার সাশ্রয় হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ইনফরমাল ও ফরমাল মিলে ভারতের সঙ্গে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় বাংলাদেশের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বর্তমানে ডলারে দেশের বাণিজ্য হয়, যেটা সম্পন্ন হয় সুইফটের মাধ্যমে। সুইফট বা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন, বিশ্বব্যাপী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আর্থিক লেনদেন করতে এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়।
এটি তাৎক্ষণিক মেসেজিং ব্যবস্থা, যা কোনো লেনদেনের ব্যাপারে গ্রাহককে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেয়। সুইফটে লেনদেনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩০ ডলার পর্যন্ত প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে রুপিতে বাণিজ্য হলে আর ডলারে কনভার্ট করার প্রয়োজন পড়বে না, এতে দেশের ডলার সাশ্রয় হবে।
রুপিতে লেনদেনে সাশ্রয় হবে ডলার, ইতিবাচক ব্যবসায়ীরা
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ভারতের সঙ্গে এতদিনে আমরা ডলার সেটেলমেন্ট করেছি, এখন রুপিতে হবে। এর আগে আমরা প্রথমে টাকাকে ডলারে কনভার্ট করতাম, পরে রুপিতে সেটেলমেন্ট। এভাবে যত জায়গায় স্টেপ দিতে হবে সেখানেই খরচ বাড়বে বা বেড়েছে। অর্থাৎ, ট্রানজেকশন যতগুলো পয়েন্ট টাচ করবে সব পয়েন্টের একটা খরচ আছে। অনেকেই বলছেন খরচ হলেও সেটা তো ব্যাংকের হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে এটা বহন করছে দুই দেশের দুই কাস্টমার (গ্রাহক)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ কর্মকর্তা বলেন, এক্ষেত্রে টাচ পয়েন্ট কমাতে পারলে গ্রাহকেরই লাভ। কারেন্সি যখন তিনটি থেকে দুটিতে চলে আসবে স্পেট কমে আসবে তখন তো কস্ট অব বিজনেসও কমবে। আমরা এখন রুপিতে বাণিজ্য শুরু করতে প্রস্তুত। রুপিতে বাণিজ্য হলে ডলারের ওপর চাপ কমবে, সাশ্রয় হবে ডলার।
এরই মধ্যে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও ইস্টার্ন ব্যাংক রুপি লেনদেনে বিশেষ (ভস্ট্রো) অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে। অনুমোদন পেয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকও। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের মতে, রুপিতে লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরিতে সাহায্য করবে না, যতক্ষণ না রুপি আইএমএফের এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বাস্কেটে এ মুদ্রা অন্তর্ভুক্ত করে।
এসডিআর বাস্কেটে অন্তর্ভুক্তি হওয়া মানে একটি আন্তর্জাতিক রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা হিসেবে গণ্য হবে। এসডিআর বাস্কেটে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পাঁচটি মুদ্রা। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন ডলার, ইউরো, জাপানিজ ইয়েন, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং চীনের ইউয়ান। চীনের ইউয়ান ২০১৬ সালে পঞ্চম মুদ্রা হিসেবে এসডিআর বাস্কেটে অন্তর্ভুক্ত করে আইএমএফ।
দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রুপিতে বাণিজ্যের সঙ্গে টাকার প্রচলনও প্রয়োজন। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘রুপিতে ট্রেড হলে এই মুহূর্তে আমাদের সুবিধা অনেক। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারছি না। এক্ষেত্রে রুপি হলে সংকট থাকবে না। কারণ ডলারের সংকট আছে, রেমিট্যান্স কম আসছে এই মুহূর্তে রুপিতে ট্রেড কাজে আসবে।’
‘একই সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ থাকতে হবে, যাতে ডলার সংকটও কেটে যায়। আমরা ভারত থেকে দুই বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করি আর আমদানি করি ১৪ বিলিয়ন ডলারের। আমদানি-রপ্তানির এ গ্যাপ কমাতে হবে। এটা কমাতে না পারলে ডলার-রুপি বা টাকায় ট্রেড যাই হোক কম কাজে আসবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘রুপিতে বাণিজ্যের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশন নিয়েছে তাতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত সূচিত হবে। আমরা পোশাকশিল্প পরিবারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘রুপিতে বাণিজ্য হলে ব্যবসায়ীরা বিনিময় হারের যে ক্ষতিটা পেত এর মাধ্যমে সেটা থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে ডলারের ওপর থেকেও নির্ভরতা কমে আসবে। পাশাপাশি ভারতেও লেনদেনের ক্ষেত্রে টাকার প্রচলন করা যেতে পারে।’