মারাত্মক এক রক্তরোগ থ্যালাসেমিয়া। জিনগত ত্রুটির কারণে এ রোগে অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। এতে লোহিত রক্তকণিকা সময়ের আগেই ভেঙে যায়। দেখা দেয় রক্তশূন্যতা। বেঁচে থাকতে সারাজীবন নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন প্রয়োজন হয় রোগীর। সেবন করতে হয় লৌহ নিষ্কাশন ওষুধ। চিকিৎসাও বেশ ব্যয়বহুল। তবে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ও অন্য রোগীদের স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন।

জানা যায়, ২০০২ সালে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকার শান্তিনগরের চামেলীবাগে ৩০ বেডের একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে ছয় হাজার ২০০ জন রোগী নিবন্ধিত থাকলেও নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন সাড়ে তিন হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী। হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী চিকিৎসা নেন।

ফাউন্ডেশনটি জানায়, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের পিছনে পরিবারের অনেক অর্থ ব্যয় হয়। গরিব মানুষের পক্ষে সেই ব্যয় মেটানো অনেক কঠিন। এ কারণে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন সরকারি অনুদান, দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুদান, জাকাত, স্পন্সর এ চাইল্ডসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে। এই ফান্ডের মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসায় সহযোগিতা করা হয়। মুসলিম গরিব রোগীদের জাকাত ফান্ড এবং অন্য ধর্মাবলম্বিদের পুয়োর ফান্ড ও অনুদান থেকে সাধারণত সহযোগিতা করা হয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ফাউন্ডেশনের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর ওমর ফারুক বলেন, আমাদের লক্ষ্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে দেশে থ্যালাসেমিয়া নির্মূল করা ও আক্রান্ত মানুষকে সেবা দেওয়া। এই মুহূর্তে ফাউন্ডেশনের অধীনে হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। যেখানে রোগীদের পরামর্শ সেবা, ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা দেওয়া হয়।

তিনি জানান, এ হাসপাতালে ২০টি বেড রয়েছে। যেখানে রোগীদের ভর্তি রাখা হয় না। দিনে এসে দিনেই সেবা নিয়ে রোগীরা বাসায় ফিরে যান। হাসপাতালে মাত্র ১০ শতাংশ রোগী আছেন যারা নিজ খরচেই সব সেবা নেন। তবে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীই অনুদান সহযোগিতা নেন। বর্তমানে আকিজ গ্রুপ ও আইটি প্রতিষ্ঠান ইনোসিস সল্যুশনস ২৬৫ জন রোগীর খরচ বহন করে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ইনোসিস সল্যুশন এই অনুদান দিচ্ছে। এবং আকিজ গ্রুপ দিচ্ছে ১৩ মাস ধরে।

তিনি বলেন, এছাড়া জাকাত ফান্ড থেকেও যে টাকা আসে তার মাধ্যমে মুসলমান রোগীদের চিকিৎসা সহযোগিতা করা হয়। অন্য ধর্মের যারা আছে তাদের পুয়োর ফান্ড ও অনুদান থেকেই চিকিৎসা সহযোগিতা করা হয়। আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিয়মিত হাসপাতালে থাকেন এবং চিকিৎসা দেন।

হাসপাতালে যে বিপুল সংখ্যক রোগী প্রতিনিয়ত রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা নিতে আসেন তাদের রক্ত কীভাবে ব্যবস্থা হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ব্লাড ব্যাংক থেকে রোগীদের রক্ত দেওয়া হয়। কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংকও আমাদের রক্ত দেয়। একই সঙ্গে রোগীদেরও নিজস্ব রক্তদাতা থাকে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে প্রতি মাসে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর মাসে পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এর মধ্যে রক্ত পরিসঞ্চালন ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই খরচ বেশি হয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের।

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিস) ডা. সাজিয়া ইসলাম জানান, থ্যালাসেমিয়া রক্তের একটি মারাত্মক রোগ। দেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ লোক থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে। এ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর পরস্পরের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে দেশে প্রতি বছর নতুন সাত হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রতি মাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকে।

মানব কোষে রক্ত তৈরি করার জন্য ২টি জিন থাকে। কোনো ব্যক্তির রক্ত তৈরির ১টি জিনে ত্রুটি থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া বাহক বলে। ২টি জিনেই ত্রুটি থাকলে তাকে রোগী বলে। একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি অন্য একজন বাহককে বিয়ে করেন তাহলে তাদের প্রতিটি সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। এ ধরনের পরিবারে একাধিক সন্তান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার নজির রয়েছে। শিশু জন্মের ১-২ বছরের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এই রোগের লক্ষণ হলো- ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ঘন ঘন ইনফেকশন, শিশুর ওজন বৃদ্ধি না হওয়া, জন্ডিস, খিটখিটে মেজাজ। এ রোগের কোনো সহজলভ্য স্থায়ী চিকিৎসা বা টিকা নেই। মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রতিরোধ করা।

বাংলাদেশে প্রতি ১৪ জনে ১ জন থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। স্বামী-স্ত্রী দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, শুধুমাত্র তখনই সন্তানদের এই রোগ হতে পারে। কিন্ত স্বামী-স্ত্রী দুজনের একজন যদি বাহক হন এবং অন্যজন সুস্থ হন, তাহলে কখনও এই রোগ হবে না। তাই বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, সবারই জানা উচিত। হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামে রক্তের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, নির্ণয় করা যায়।