রমজান বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জন্য পবিত্র রোজার মাস। এটি এমন একটি নিয়ম যখন রোজাদার মুসলমানরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকে। এটি একটি ফরজ ইবাদত যা শারীরিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বাসী মুসলমানদেরকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের সুযোগ করে দেয়।

তবে  হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য রমজানে রোজা রাখা কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। একজন হৃদরোগী কিভাবে এসব ঝুঁকি এড়িয়ে রোজা থাকতে পারে নিচের আলোচনা থেকে এব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাবে।

হৃদরোগ বলতে হৃদপিণ্ড,  বিশেষ করে এর  রক্তনালীর মধ্যে চর্বির স্তর জমে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়া এবং তা থেকে উদ্ভুত কয়েকটি রোগকে বোঝায়। করোনারি আর্টারি ডিজিজ, হার্ট ফেইলিওর এবং অ্যারিদমিয়ার মতো রোগগুলি এর অন্তর্ভুক্ত। রোজা থাকা কালে সারাদিন উপবাসের ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে, রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে  এবং রক্তচাপ কমে যেতে পারে, যা হৃদরোগীর রোগের লক্ষণগুলিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।  তাই, হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রমজানে রোজা রাখার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।

আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন: হৃদরোগে আক্রান্ত একজন যিনি রমজান পালন করতে চান তার জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হল তার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা।  ডাক্তার রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন করবেন এবং রোজা রাখা নিরাপদ কি না সে বিষয়ে পরামর্শ দেবেন।  যদি ডাক্তার রোজা রাখা নিরাপদ মনে না করেন তবে রোগীকে তাঁর পরামর্শ অনুসরণ করা উচিত।

আর যদি ডাক্তার পরামর্শ দেন যে রোজা রাখা নিরাপদ, তবে রোজায় রোগীকে তার নিজের  অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।  তাকে নিয়মিত নিজের রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করা উচিত এবং একটি ডায়েরিতে লিখে রাখা উচিত।  যদি রোগীর  অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন থেকে থাকে তবে তাতে কোন পরিবর্তন হলে তা  নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং প্রয়োজনে ডাক্তারকে জানানো উচিত।

নির্দেশিত ওষুধ সেবন করুন: হৃদরোগীরা সাধারণত তাদের শরীর ও হার্ট ভালো রাখার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন ঔষধ  খেয়ে থাকেন। রমজান মাসে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া অপরিহার্য।  ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করে তাদের ঔষধ  খাওয়া বন্ধ করা বা ডোজ পরিবর্তন করা একেবারেই উচিত নয়। ডায়াবেটিসের রোগী তার ঔষধ ও ইনসুলিন এর মাত্রা ও এর ব্যবহারের সময় পরিবর্তন করে নিতে হতে পারে।

সাবধানে খাবারের পরিকল্পনা করুন: রোজাদারেরা সাধারণত রমজানে দুটি খাবার খায়, সেহরি ও ইফতার।  এই খাবারগুলি যাতে  পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং সারাদিনের পানির চাহিদা পূরণ করে তা নিশ্চিত করার জন্য সাবধানতার সাথে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।  কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, প্রোটিন এবং চর্বি সহ খাবারগুলি সুষম হওয়া উচিত।  ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা রোধ করতে ইফতারের সময় ও পরে প্রচুর পানি এবং অন্যান্য তরল পান করাও গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন: রমজান মাসে বেশিরভাগ লোক ইফতার এবং সেহরির সময় উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং  উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার খেয়ে থাকে। এই খাবারগুলি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে এবং ওজন বাড়াতে পারে, যা হৃদরোগকে আরও জটিল  করে তুলতে পারে।  অতএব, এই খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত। এগুলির পরিবর্তে  ফল, শাকসবজি এবং সেঁকা রুটি, অল্প ভাত, মাছ, মুরগির মাংস,  ডিম ও ক্রিম ছাড়া দুধের মতো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অপরিহার্য।

ব্যায়াম: রমজানে রোজাদার হৃদরোগী ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। তবে এ সময়ে কঠোর ব্যায়াম করা উচিত নয়। বরং বিকালে হাল্কা ব্যায়াম করে ইফতার এর পরে বা তারাবি নামাজের পরে রোগীর অভ্যাস অনুযায়ী  ব্যায়াম করা উচিত। তাছাড়া তারাবি নামাজ পড়লে এটি থেকেও একটি ব্যায়ামের উপকার পাওয়া যায়।

বিশ্রাম: রমজান মাসে বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে হৃদরোগীদের জন্য। কর্মরত অবস্থায় বা গরমে অস্বাভাবিক ক্লান্তি  বোধ হলে সাময়িক  বিরতি এবং বিশ্রাম নেওয়া উচিত।  তাদের কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন এবং সকালে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠা উচিত না, কারণ এটি তার সারাদিন ক্লান্তির কারণ হতে পারে। তাছাড়া এথেকে প্রেশার ও হার্টের অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে যেতে পারে।

বিশেষ সাবধানতা: রমজানে রোজা থাকা অবস্থায় যদি রোগীর বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরার মতো কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে তার অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।  এই লক্ষণগুলি অবজ্ঞা করা উচিত না, কারন এগুলি গুরুতর কোন সমস্যার শুরু হতে পারে যার জন্য জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন।

রমজানে রোজা রাখা হৃদরোগীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে সাবধানে পরিকল্পনা করে এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে  নিরাপদে রোজা রাখা সম্ভব।  রোগীর রোজা রাখার আগে তাদের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত, তাদের অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত, নির্ধারিত ওষুধ সেবন করা উচিত, তাদের ইফতার ও সেহরি খাবারের পরিকল্পনা করা, ব্যায়াম করা, বিশ্রাম নেওয়া এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।  এই পরামর্শগুলি সঠিকভাবে অনুসরণ করে, হৃদরোগে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি  তার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বজায় রেখে নিরাপদে রমজান পালন করতে পারে।

ডা: এস এম ইয়ার ই মাহাবুব
সহযোগী অধ্যাপক,  কার্ডিওলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ