প্রতিবছর রমজান মাসে তেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজীয় দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দাম। ব্যবসায়ীরা কৌশলে বিগত কয়েক বছর রোজার দুই-এক মাস আগে থেকেই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন কেউই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গত বছর রমজানে রিট করেও লাভ হয়নি। শুনানি থমকে আছে এক বছর ধরে।

সারা দেশে সয়াবিনসহ তেলের বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন ও নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ৬ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী মনির হোসেন, সৈয়দ মহিদুল কবীর ও মোহাম্মদ উল্লাহ। এতে বাণিজ্য সচিব, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ১৫ মার্চ সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এসময় ওএমএস নীতিমালা অনুযায়ী সারাদেশে চাল, আটা, তেল, পেঁয়াজ, ডাল রেশন কার্ডের মাধ্যমে দিতে রুল জারি করেন আদালত। এছাড়া সয়াবিন তেল মজুত করার অভিযোগে আটকদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

সাধারণভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়া-কমার বিষয়টি নির্ভর করে বাজারে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে পণ্যের দাম বাড়তেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ম খাটছে না। প্রতিকারে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যবৃদ্ধি রোধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন তিন আইনজীবী। রিটের পর উচ্চ আদালত বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। সঙ্গে রুলও জারি করেন।

এ সংক্রান্ত রুলের শুনানি থমকে আছে এক বছর। গত বছরের রমজান থেকে চলতি বছরের রমজান পর্যন্ত অপেক্ষা করেও রুলের বিষয়ে শুনানি হচ্ছে না বলে জানান রিটকারী আইনজীবী। তবে তারা রিটের শুনানির জন্য এখনো প্রস্তুত।

এর আগে একই বছর ৩ মার্চ সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন এ তিন আইনজীবী। তারা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন। আদালত আইনজীবীদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিট করার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী রিট করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

পরে রুল জারির পাশাপাশি ভোজ্যতেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রতিবেদন আকারে জানাতে বলেন আদালত।

এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মুহিদুল কবীর বলেন, আমরা গত বছরের রমজানে রিটের ওপর জারি করা রুলের বিষয়ে শুনানি করবো বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু গত এক বছরেও শুনানি করতে পারছি না। রিটটি জারি করা রুলের বিষয়ে শুনানি করতে না পারার কারণ অজানা। তবে আমার ধারণা অন্য মামলার চাপে গুরুত্বপূর্ণ হলেও রিটটির শুনানি হচ্ছে না।

এই আইনজীবী আরও বলেন, দেখা যায়, আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ থাকলেও তা বেশি দামে বিক্রি হয়। দ্রব্যমূল্যের এ অযৌক্তিক বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে বাজার সিন্ডিকেট বা চক্র। তারা যোগসাজশের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। নানা অজুহাত তুলেও বাড়ানো হয় পণ্যের দাম। এ অবস্থায় বেশি দামে পণ্য কেনা ছাড়া ভোক্তাদের কোনো উপায় থাকে না।

‘এভাবে দ্রব্যমূল্য, বিশেষত নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো অপরাধ বটে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল। ফলে কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের এ প্রবণতা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারের। ব্যবসায়ীরা কায়েমি স্বার্থে ইচ্ছামতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে, আর সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, এটা চলতে পারে না। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করার অনুরোধ করছি। এটি সরকারের দায়িত্বও বটে।

আইনজীবী সৈয়দ মহিদুল কবির বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। বণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিদপ্তরে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ আইনেও আমরা প্রতিকার পাচ্ছি না। ভোক্তার অধিকার রক্ষা হচ্ছে না। সারা দেশের মানুষ কষ্টে আছে। তারা সহনীয় দামে কোনো জিনিস কিনতে পারছে না। নিরাপদ খাদ্য ও প্রতিযোগিতা কমিশনও সঠিক কাজ করছে না।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল শ্রী সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, নিত্যপণ্য ও তেলের দাম নিয়ে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল এবং নির্দেশনার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকারের প্রতিবেদন এসেছিল। আমরা সেটি আদালতে জমা দিয়েছিলাম। এর পরে এ বিষয়ে আর কোনো শুনানি হয়নি। তবে রিটকারীর পক্ষ থেকে শুনানি করতে এলে আমরা সে বিষয়ে শুনানিতে প্রস্তুত। কোর্টকে যে বিষয়ে সহযোগিতা করা দরকার সেটি আমরা করবো।

তিনি বলেন, রুলটি এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে। মূলত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এগুলো কোর্টের সামনে তারা এভিডেবিট করে বলেছেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সারা দেশে কী কী করেছে সেটিও জানিয়েছেন।

সরকারের এই আইনজীবী আরও বলেন, রিটকারী সংশ্লিষ্টদেরই আসা উচিত শুনানির জন্য। হয়তো মামলার চাপের কারণে রিট ও রুলটি শুনানি হচ্ছে না।