চাঁদপুর-১ (কচুয়া) জাতীয় সংসদের ২৬০ নম্বর আসন। ‘উপচেপড়া’ উন্নয়নেও এ আসনটিতে বাড়েনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোট। দলে বিভক্তির কারণে নিজস্ব বলয় শক্ত করতে মাদক, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে প্রশ্রয় দেওয়ায় ভোট কমেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা বিএনপিরও সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। রয়েছে বিভাজন। তবে তাদের সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে রয়েছে ঐক্য। ভোটের সুযোগ পেলে সেটির প্রতিফলন ঘটবে, এমনটাই দাবি স্থানীয়দের। বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আসনটি একচেটিয়া কোনো দলের ঘাঁটি নয়। ভোটের অনুপাতে দলগতভাবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কাছাকাছি। স্বাধীনতার পর দুবার জাতীয় পার্টি, তিনবার বিএনপি এবং চারবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী এখান থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৬ থেকে এখানে উল্লেখযোগ্য হারে উন্নয়ন হয়েছে। সড়ক অবকাঠামো, স্কুল-কলেজসহ নানা উন্নয়ন কাজ চোখে পড়বে এলাকা ঘুরলেই। তবে সারাদেশের মতো এখানেও রয়েছে মাদকের ছোবল। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির এখানে অভিনব নাম ‘মলম’। একটা বিশেষ গ্রুপ আছে- যারা কোনো কাজ করে না। ঘুরে বেড়ায়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তাদের ছত্রছায়ায় থাকে। আর হাট-বাজার বা শহরে দোকান-ভবনের কাজ করলে চাঁদা দাবি করে। না দিলে করে হেনস্তা। এদের সবাই ‘মলম’ ডাকে। নিজের বলয় শক্ত করতে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন গ্রুপ তাদের সহায়তাও করে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এই আসনে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের দৌড়ে আছেন তিনজন। এরা হলেন- বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। দলগতভাবে এলাকায় তাদের আলাদা গ্রুপ আছে। তবে গত নির্বাচনের পর থেকে ড. সেলিম মাহমুদই এলাকা ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন। করোনার সময় নানা সহায়তা ও শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা কর্মকাণ্ডে দেখা গেছে তাকে। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কেন্দ্রকেও সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছেন তিনি।
এছাড়া আসনটিতে আওয়ামী লীগের আঞ্চলিকতার সেন্টিমেন্ট আছে। পুরো আসনটি উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত। উত্তরাঞ্চলের এরিয়া বড়, ভোটার বেশি। অথচ আকারে ছোট ও ভোটার কম দক্ষিণ কচুয়ায়, কিন্তু নেতা বেশি। উত্তরে ড. সেলিম মাহমুদ একমাত্র নেতা। যে কারণে আঞ্চলিক ভোটের অনুপাতেও ড. সেলিম মাহমুদ এগিয়ে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংশ্লিষ্ট তিনি। যার কারণে স্থানীয়দের ধারণা, তাকেই দেওয়া হতে পারে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন।
এদিকে, বিএনপিতে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন তুমুল জনপ্রিয় হলেও গত নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন প্রবাসী মোশাররফ হোসেন। এরপর থেকে দলটির নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত। যদিও মাঠ পর্যায়ে সমর্থক ও ভোটাররা বলছেন, ‘দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি আছে। কিন্তু ভোটার ও সমর্থকরা ঐক্যবদ্ধ। তারা ধানের শীষের পক্ষে। বেশিরভাগ মিলন সাহেবের পক্ষে।’
কচুয়া উপজেলার রহিমানগর বাজারে চায়ের আড্ডায় কথা হয় একাধিক ভোটারের সঙ্গে। তাদের বেশিরভাগ সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত। তাদের একজন সাব্বির আহমদ (ছদ্মনাম)। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি মিলন (এহসানুল হক মিলন) সাহেবের লোক। এখানে সবাই চেনে। আমরা এত জেল-জুলুম ও মামলার পরও টিকে আছি। বিএনপির পক্ষে মিলন সাহেবের হয়ে দলটা গুছিয়ে রাখছি। কুমিল্লায় বিভাগীয় সমাবেশ হলো- দলের অন্য প্রার্থী টাকা দিয়েছে লোক নেওয়ার জন্য। আর আমরা নিজ খরচে মিলন সাহেবের পক্ষে গেছি। সেখানে মিলন সাহেবের ছবিসহ গেঞ্জি পরে স্লোগান দিয়েছি। এটা শুধু দলের প্রতি ভালোবাসা ও মিলন সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন।
তিনি বলেন, এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে মিলন সাহেবকে ঠেকানোর কেউ নেই। তবে অন্য প্রার্থী দিলে বা যেভাবে গত দুটি নির্বাচন হলো, এভাবে হলে তো কোনো কথা নেই। বিএনপি ভোটেই যাবে না। আমরাও মাঠে থাকবো না।
তার কথায় সমর্থন দিলেন আরেকজন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিয়ন পর্যায়ের ওই আওয়ামী লীগ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, জয় নিতে হলে ভোট চাপতে হবে। ভোট না চাপলে বা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবার আওয়ামীবিরোধী যেই আসুক পাস করবে। কারণ, আওয়ামী লীগ নানাভাবে বিভক্ত। এত উন্নয়ন হলেও সেটার সুফল ঘরে তোলায় ব্যস্ত নয় তারা। ব্যস্ত ব্যক্তি স্বার্থ নিয়ে। বিশেষ করে, ভোট নষ্ট করে ‘মলম’রা। প্রতিটি বাজারে, এমনকি গ্রামগঞ্জেও এদের উৎপাত। নিজের লোক বলে নেতারাও এদের বাঁচায়। যার কারণে জনমনে দলের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।’
প্রবাসী মো. আলম বলেন, আসলে এখন মানুষ রাজনীতিবিমুখ। ত্যাগী নেতাকর্মীরাও নিশ্চুপ। হাতেগোনা কিছু নেতাকর্মী ও সুবিধাবাদী সক্রিয় বিভিন্ন এলাকায়। এরাই নেতাদের কাছে যায়। নতুন নতুন নেতাও এদের নিয়েই রাজনীতি করেন। তাদের বেশিরভাগেরই এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা নেই। জাস্ট নেতাকে ভাঙিয়ে খায়। বিভিন্ন তদবির করে। আবার কদিন পর নতুন কেউ এলে সেখানে ভিড় জমাবে। গ্রুপ তৈরি করা আর পাল্টানোই তাদের কাজ।
তারা বলছেন, আমরা মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। দলীয় মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো। মানুষ নিশ্চয় কাজের মূল্যায়ন করবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ২০২০ এর শুরু থেকে বর্তমান এমপি এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন। গত তিন বছর টানা আমিই একমাত্র রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশে থাকার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সুখ-দুঃখে পাশে ছিলাম। প্রতিটি ইউনিয়নে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাইফো অক্সিজেন দিয়েছিলাম। প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা সামগ্রী বিতরণ করেছি। কয়েকদিন আগে শীতে ১৩ হাজার কম্বল দিয়েছি। ঈদসহ নানা উৎসব পার্বনেও আমি নানা উপহার সামগ্রী নিয়ে এলাকার মানুষের পাশে ছিলাম। এলাকার ছাত্রলীগের কমিটিসহ সব ইয়াং ফোর্স আমার ডাকে মাঠে নেমে গেছে।
তিনি বলেন, অনেকে রাজনীতি করেন বাই চান্স। একটা পদ পেলেই শুরু। কিন্তু আমরা রাজনীতি করি মানুষের জন্য। আমি ২৮ বছর আগেই (২৪ বছর বয়সে) বাবার দেওয়া তিন একর জমিতে ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। অনেকে তো চাকরি শেষ করে, এক্সেটেনশন নিয়ে সেটাও শেষ করে রাজনীতি করে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালীন ১৬ বছর চাকরির বয়স থাকার পরও স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে রাজনীতিতে এসেছি।
ড. সেলিম বলেন, শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও আমি জয়লাভ করবো। গত কয়েক মেয়াদে এমপি মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং এহসানুল হক মিলনের ভালো-খারাপ দুটো দিকই মানুষ দেখেছে। বর্তমান এমপির বয়স ৮৩ বছর। তিনি শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল। স্থানীয় নেতাকর্মীরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য নতুন নেতৃত্বের প্রত্যাশা করে।
নিজেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী দাবি করে সাবেক সচিব গোলাম হোসেন বলেন, এখানে বিভাজন বলতে কিছু নেই। হয়তো মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনুসারী আছে। আমি মনোনয়ন পেলে সবাইকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করবো। এখন যারা কাজ করছেন তাদের প্রতিও আমার আহ্বান থাকবে, তারা যেন সে পরিবেশ বজায় রাখেন।
অন্যদিকে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আ ন ম এহসানুল হক মিলন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন তো হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর বিএনপি তো স্পষ্ট বলেই দিয়েছে, তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আপনি লিখে রাখেন, যদি নির্বাচন এই সরকারের অধীনে হয়- আওয়ামী লীগ জোর করে নিয়ে নেবে। আর যদি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়, তাহলে ওরা (আওয়ামী লীগ) ফেল মারবে।
দলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং নির্বাচনে ক্ষতির কারণ হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তো গ্রুপিং নেই। কচুয়ায় আমার স্ত্রী নাজমুন নাহার বেবী কাজ করছে, ওর সঙ্গে আমি আছি। এর বাইরে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই কচুয়ায়। কখনো ছিল না, এখনো নেই। গতবার নির্বাচনে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তিনি মনোনয়ন পাওয়ার পর দুদিন কচুয়া ছিলেন। এর আগে বা পরে তিনি কখনোই এলাকায় যাননি। বুঝ হওয়ার পর সারাজীবনে ওই দুদিনই ছিলেন কচুয়ায়। এ সত্যটা কেউ বলে না। দেশ যেভাবে চলছে, আমরাও সেভাবে চলছি।
কচুয়া উপজেলা নিয়ে সংসদের ২৬০ নম্বর আসন চাঁদপুর-১। এখানে মোট ভোটার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫০ জন। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮৫ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৫।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিএনপির মোশাররফ হোসেনকে পরাজিত করে এমপি হন। ১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।
৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) মহীউদ্দীন খান আলমগীর নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬১ ভোট পান। বিএনপির এহসানুল হক মিলন ধানের শীষ প্রতীকে পান ৮০ হাজার ৮৭২ ভোট।
৮ম সংসদ নির্বাচন (২০০১) বিএনপির এহসানুল হক মিলন ধানের শীষ প্রতীকে ৮৫ হাজার ৫০৭ ভোট পান। আর আওয়ামী লীগের মহীউদ্দীন খান আলমগীর ৬২ হাজার ৫৩৭ ভোট পান।
৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) বিএনপির এহসানুল হক মিলন ধানের শীষ প্রতীকে ৩৪ হাজার ২৪০ ভোটে জয় পান। আওয়ামী লীগের মেজবাহ উদ্দিন খান নৌকা প্রতীকে পান ৩১ হাজার ২১৪ ভোট।
৫ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) আওয়ামী লীগের মেজবাহ উদ্দিন খান নৌকা প্রতীকে ২৫ হাজার ৭৩২ ভোটে জয় পান। বিএনপির আবুল হাসানাত ধানের শীষ প্রতীকে ২৫ হাজার ২৩২ ভোট পান।
এর আগের ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির রফিকুল ইসলাম রনি এবং ১৯৮৮ সালে একই পার্টির এ কে এস এম সহিদুল ইসলাম এমপি নির্বাচিত হন।