নতুন আলোয় আলোকিত হলো দেশের উত্তরাঞ্চল। পাইপলাইনে তেল সরবরাহের মাধ্যমে এখন দিন বদলের পালা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের।

শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, এ অঞ্চলে তেল চলে এসেছে। গ্যাসও আসছে। তেল ও গ্যাসের সমস্যা না থাকলে গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা, ইপিজেড, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণের হিমাগার। বাড়বে কর্মসংস্থান। সমৃদ্ধ হবে মানুষের জীবনমান। স্বাভাবিক কারণেই গতি আসবে দেশের অর্থনীতিতে ও।

১৮ মার্চ বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের উদ্বোধনের মাধ্যমে ১৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনে তেল আমদানি কার্যক্রম শুরু হয়। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে দুই লাখ টন ডিজেল আসবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির নুমালীগড় রিফাইনারি থেকে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আমদানি করা এ তেল দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় সরবরাহ করা হবে। এছাড়া নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রেও এই ডিজেল সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশ অংশে বিপিসির পক্ষে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (এমপিএল) ও ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা ডিজেল সংরক্ষণের জন্য পার্বতীপুর রিসিভ টার্মিনাল সাইটে ২৯ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি বাফার ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি মজুতের সক্ষমতা রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, উত্তরের ১৬ জেলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সারাবছর ডিজেল সরবরাহ রাখতে এই ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন ভূমিকা রাখবে। আগে খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে রেল ওয়াগনের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে তেল আসতে সময় লাগতো ৬-৭ দিন। এখন সাশ্রয়ী উপায়ে দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

নীলফামারী চেম্বর অব কমার্সের সভাপতি সফিকুল আলম বলেন, পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে এখন শিল্পবিপ্লব ঘটবে বলাই যায়। অনেক উদ্যোক্তা এরইমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। অনেকে পরিকল্পনা করছেন।

তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলের উত্তরপ্রান্তে প্রচুর সবজি হয়। সঙ্গে অন্যান্য ফসলও হয় রেকর্ড পরিমাণে। এখানকার মাটি উর্বর। যেকোনো ফসল ফলিয়ে তা দেশের বাইরে পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো, শ্রমিকের মজুরিও অনেক কম। যার কারণে নিরবচ্ছিন্ন তেল ও গ্যাস পেলে এখানে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রয়োজনীয় জমি ও বিপুল জনশক্তির সহজপ্রাপ্যতায় উদ্যোক্তারা বরাবরই এ অঞ্চলে বিনিয়োগে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু গ্যাস ও তেলের যোগান না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন। মৌসুমে মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন, অনিয়ন্ত্রিত বাজার, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সিন্ডিকেট এবং উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতের সুযোগ না থাকায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বেশিরভাগ সময় তাদের উৎপাদন খরচটুকুও পান না।

অথচ এসব সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে একদিকে যেমন সম্পদকে অর্থে রূপান্তর করা সম্ভব, তেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব কমানো সম্ভব। এমনকি বিদেশে রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা অনেক সহজ হবে।

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, দেশের খাদ্য চাহিদার ৫০ শতাংশ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল উত্তরাঞ্চল থেকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে এখনো বড় আকারে কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। দেশের মোট শিল্পের মাত্র প্রায় ১২ শতাংশ উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত।

এদিকে মৌসুমি ফসল, বিশেষ করে শীতকালীন সবজিচাষ প্রচুর পরিমাণে হয়ে থাকে এ অঞ্চলে। তাই উত্তরবঙ্গ হতে পারে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পাঞ্চল।

অন্যদিকে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ডিজেল। বছরে ডিজেলের চাহিদা প্রায় ৪৬ লাখ টন, যার ৮০ শতাংশই সরকার সরাসরি আমদানি করে।

বিপিসি সূত্রে জানায়, বর্তমানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। আর পরিশোধিত তেল আমদানি করা হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চলছে। এ অবস্থায় পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আনার কারণে ব্যয় ও সময় দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে।

পাইপলাইন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) টিপু সুলতান বলেন, পাইপলাইনের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অংশে ১২৬ কিলোমিটার দূরত্বে প্রতি ৩০ কিলোমিটারে ৫টি এসভি স্টেশন (সেকশনালইজিং ভালভ) স্থাপন করা হয়েছে। ভারতের আসাম রাজ্যের নুমালীগড় রিফাইনারির শিলিগুড়ি মাকেটিং টার্মিনাল থেকে সীমান্তের বর্ডার অতিক্রম করে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পঞ্চগড়, নীলফামারী, দিনাজপুর হয়ে পার্বতীপুর ডিপোতে সংযুক্ত হয়েছে পাইপলাইনটি। শিলিগুড়ির নুমালীগড় রিফাইনারি থেকে ইন্দো-বাংলা ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল বিপিসির পার্বতীপুর টার্মিনালে আসছে।

উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা ৫ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। তাছাড়া নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কৃষি সেচ মৌসুমে বেশি জ্বালানি প্রয়োজন হয়ে থাকে। ওই সময় জ্বালানি তেলের চাহিদা ঠিক থাকে না। এতদিন উত্তরাঞ্চলের জেলায় নৌ ও রেলপথে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হতো। সিস্টেম লস কমাতেই এ উদ্যোগ নিয়েছে বিপিসি।

বিপিসি সূত্র আরও জানায়, জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রে প্রতি ব্যারেলে (১৫৯ লিটার) গড়ে ১০ ডলার প্রিমিয়াম (জাহাজ ভাড়াসহ অন্য খরচ) দিতে হয় বিপিসিকে। ভারত থেকে আনার ক্ষেত্রে এটি আট ডলার হতে পারে। প্রতি ব্যারেলে দুই ডলার কমলে প্রতি এক লাখ টনে প্রায় ১৫ লাখ ডলার সাশ্রয় সম্ভব। জ্বালানি সরবরাহে সময় কম লাগার পাশাপাশি এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষ।

ভারত থেকে উত্তরাঞ্চলের পার্বতীপুর রেলহেড ডিপোতে ডিজেল আসতে সময় লাগছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। সেখান থেকে উত্তরের বিভিন্ন জেলায় তা সরবরাহ করা হবে। এতে পরিবহন ব্যয়ও অনেক কমে যাবে।

বর্তমানে আমদানি করা জ্বালানি তেল পার্বতীপুরে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল ভারত থেকে আমদানি করা সম্ভব হবে।

সেচ নির্ভর এই অঞ্চলে প্রতিবছর বোরো আবাদ মৌসুমের শুরুতেই জ্বালানি তেলের কিছুটা সংকটে পড়তে হয় রংপুর বিভাগের ৮ জেলাসহ পাশের রাজশাহী বিভাগের অনেক জেলায়। বোরো ধানের আবাদ শুরু হলে হঠাৎ তেলের চাহিদা বেড়ে যায়। এসব জেলায় জ্বালানি সরবরাহ করা হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির পার্বতীপুর রেলওয়ে হেড ডিপো থেকে।

এ ডিপোর তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন ডিজেলের চাহিদা থাকে গড়ে ১৫ লাখ লিটার। বোরো মৌসুমে দৈনিক তেলের চাহিদা বেড়ে হয় ২০-২২ লাখ লিটার। এখন পাইপলাইনে তেল আসায় এসব সমস্যা আর থাকছে না বলেও জানান বিপিসির কর্মকর্তারা।