প্রতিবেশী দেশ ভারত ইস্যুতে বরাবরই ফায়দা লুটেছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ যখন ভারতের ওপর আস্থা রেখেছে তখন বিএনপি পুঁজি করেছে ভারতবিরোধিতা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির জামায়াত বৈরিতা, সম্প্রতি ভারতীয় হাইকমিশনে শীর্ষ নেতাদের নৈশভোজ প্রভৃতি ইস্যুতে ফের চর্চায় গুরুত্ব পাচ্ছে বিএনপি-ভারত সম্পর্ক। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপিকে ভারতবিরোধী তকমা দিয়ে আওয়ামী লীগ সব সময় রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্পর্ক আসলে কোন পথে যায় সেটা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা প্রয়োজন।

ভারত-বিএনপি সম্পর্কের অতীত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন নানা কারণে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় আসার বিষয়টি সেসময় ভারত খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ভারতকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের বড় অংশজুড়ে ভারতের সীমান্ত থাকায় দেশটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোটকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের পতন হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন অনেকটাই স্পষ্ট ছিল যে, ভারতের সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের ওপর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি।

২০১২ সালের পর থেকে রাজপথের আন্দোলনে নামে বিএনপি জোট। এর মধ্যে ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকা সফরে আসেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তার সফরের সময় বিএনপির ডাকে হরতাল চলছিল। হরতাল বহাল রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তখন প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করেননি। সেখান থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হয় বিএনপির। জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে আসেন। নির্বাচন নিয়ে চলমান সংকটের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে সফরে এসে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে অনেকটাই ‘চাপ’ প্রয়োগ করে রাজি করেন বলে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন না হলে মৌলবাদ চাঙা হতে পারে।

এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি অনেকটাই প্রকোশ্য সমর্থন ছিল ভারতের। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন করে ভাবতে শুরু করে বিএনপি। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাগিদ অনুভব করেন বিএনপি নেতারা।

জানা যায়, ২০১৮ সালের পর জামায়াতকে জোটে সরাসরি না রাখার যে সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছে সেখানে ভারতকে আস্থায় আনার বিষয়টি রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের জামায়াতবিরোধী বক্তব্যও ভারতসহ পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করার কৌশল বলেও অনেকে মনে করেন। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও চেষ্টা করছেন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে। কিছুদিন আগে ঢকায় ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর সঙ্গে বিএনপি নেতাদের একাধিকবার বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয়। এসব বৈঠকে ভারতের চাওয়া অনুযায়ী জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মৌলবাদ মোকাবিলায় আগামীতে সোচ্চার থাকবে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বলে চাউর আছে। এছাড়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আগের মতো ভারতবিরোধী কট্টর বক্তব্য দেওয়া থেকে সরে এসেছেন বিএনপি নেতারা। মাঝে-মধ্যে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিলেও সেটিকে ‘আইওয়াশ’ বলে মনে করছেন অনেকে।

ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক যে আগের তুলনায় ভালো সেটির উদাহরণ হিসেবে অনেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বিষয়টি সামনে আনছেন। সম্প্রতি শিলংয়ের আদালত থেকে অনুপ্রবেশের দায়ে করা মামলায় খালাস পান তিনি। সেখান থেকে বিএনপির সভায়ও ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন সালাহউদ্দিন। দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। যদিও স্বাধীন বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতের রায়ে তিনি খালাস পেয়েছেন তারপরও ঢাকার কেউ কেউ মনে করছেন এখানে ভারত সরকারের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

গত ১৬ মার্চ সন্ধ্যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার বাসায় যায়। প্রণয় ভার্মার আমন্ত্রণে এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সেখানে নৈশভোজে অংশ নেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ওই নৈশভোজে অংশ নেন। এর আগে ১২ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের পর ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে ওই বৈঠক এবং পরে ২৩ মার্চ বিএনপির শামা ওবায়েদের সঙ্গে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠক বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। আগামীতে ভারতীয় হাইকশিনারের সঙ্গে আরও একাধিক বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারত-বিএনপি সম্পর্ক নিয়ে দলটির বিদেশ বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ- আওয়ামী লীগ এ ধারণা তৈরি করে রাজনীতিতে সুবিধা নিতে চায়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কোনো সময় খারাপ ছিল না বরং সব সময় ভালো ছিল, ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে।

বিএনপিকে আস্থায় নিতে ভারতের নৈশভোজ নাকি তাদের কৌশল- আপনারা এটা কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তারা (ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা) বলতে পারবেন। তবে আমি মনে করি এটা একটা নৈশভোজ। পত্রিকায় সংবাদ বের হয়েছে ভারতের নতুন হাইকমিশনার এসেছেন আমাদের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।

ভারতের সঙ্গে বিএনপির আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে শামা ওবায়েদ বলেন, তারা আমাদের কাছে বিএনপির রাজনৈতিক পরিকল্পনা জানতে চায়। সরকার গঠন করলে কীভাবে সেটা পরিচালিত হবে সে বিষয়ে জানতে চায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। ২০১৮ সালেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে কিন্তু তার আগের রাতে ভোট হয়েছে। তাই আমরা এমন একটা নির্বাচন ব্যবস্থার কথা বলেছি যেন মানুষ ভোট দিতে পারে। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না এটা গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি সরকার গঠন করবে।

আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান ভারতেরও সেই একই অবস্থান কি না। আপনারা ভারতের সঙ্গে সবশেষ বৈঠকে কী দেখছেন- এমন প্রশ্নে শামা ওবায়েদ বলেন, না, ভারতের সঙ্গে সবশেষ বৈঠক হয়নি, ওটা একটা নৈশভোজ ছিল এবং পরবর্তীসময়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন, ওটা অফিসিয়াল কোনো বৈঠক ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা সেখানে হাইকমিশনারের আমন্ত্রণে নৈশভোজে গিয়েছিলাম। মূলত এটি একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল। এখানে রাজনৈতিক বিষয়ের মূল্য ছিল না।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোনোদিন খারাপ ছিল বলে আমার জানা নেই। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে শুধু ভারত নয়, যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের সমর্থন যে কেউ চাইতে পারে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ভারতসহ সব দেশের সঙ্গে বিএনপির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সব দেশে আমাদের বন্ধু রয়েছে। আমাদের দলের গঠনতন্ত্রেও তাই আছে। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনাকালে আমরা সেটা অনুসরণ করেছি। সুতরাং, নতুন করে কারও সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়োজন নেই।

ভারতীয় হাইকমিশনারের নৈশভোজে বিএনপি নেতাদের অংশ নেওয়া দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা নৈশভোজের দাওয়াত দিয়েছেন, আমরা সেখানে গিয়েছি। এটা স্বাভাবিক সৌজন্য, নতুন কিছু নয়।

ভারত-বিএনপি সম্পর্ক বিষয়ে দীর্ঘদিনের চর্চা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, স্বাধীন একটা দেশে যদি ক্ষমতায় আসতে বিদেশিদের সহযোগিতা লাগে তাহলে এদেশের মানুষের জন্য আমার কষ্ট হয়। আর রাজনৈতিক দলগুলোকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। তবে, দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে ভারতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সহযোগিতা চান, সেখানে বিএনপি ভারতকে আস্থায় রাখতে চাওয়া খারাপ কিছু বলে আমি মনে করি না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে খেলা করে এটি অসত্য নয়। তবে, বিষয়টি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, আমি মনে করি এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এটা নিতান্তই সৌজন্যতার ব্যাপার। তবে এটার তো একটা গুরুত্ব আছে, যেহেতু দলটি বিএনপি এবং যাদের সঙ্গে নৈশভোজ হচ্ছে দেশটির নাম ভারত। অতীতে কোনো এক সময় বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি থেকে উল্লেখিত দলটি বেনিফিটেড হয়নি এটা বলা যাবে না। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে দৃশ্যত বিএনপি প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা থেকে সরে এসেছে।

‘এটার দুটো দিক আছে। এক. বিশ্ব বাস্তবতা-আঞ্চলিক বাস্তবতা। আবার একটা প্রশ্ন থেকে যায় তাহলো বাংলাদেশে ভারতবিরোধী যে একটা সেন্টিমেন্ট আছে সেটা কে বা কারা তুলবে? এটা একটা বাস্তবতা। রাইট হোক রং হোক যে কোনো কারণে হোক বিভিন্নভাবে যেহেতু ভারতবিরোধী একটা সেন্টিমেন্ট এখানে আছে।’

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ডোন্ট আস্ক ডোন্ট টেল পলিসি’ দেখা যায়। এখন ওনারা এটা নিয়ে কথাও বলেন না, প্রশ্ন তুলতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেন না। এখন যেহেতু নির্বাচনী বছর বিভিন্ন পক্ষই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে।

ভারতের হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে বা বিএনপির পক্ষ থেকে হোক, এখন পর্যন্ত আমার কাছে মনে হয় এটা এক ধরনের ট্রায়াল। একটা গিয়ারআপ হচ্ছে বা এক ধরনের সৌজন্য। পরবর্তীসময়ে কতটুকু সৌজন্য সম্পর্ক শাণিত হবে, নাকি আদৌ হবে না কিংবা এখন যেমন আছি তেমন থাকবে- এগুলো বলার মতো সময় এখনো হয়নি।