গ্রামে কৃষি কাজের পাশাপাশি মুরগির খামার করে কিছু টাকা হাতে পেতেন কৃষকরা। আবার মুরগির খামারে দিয়ে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছিলেন অনেক বেকার যুবক। কিন্তু মুরগির বাচ্চার সংকটে সেই রোজগার এখন বন্ধ প্রায়। বেশি দামেও বাচ্চা না পেয়ে অধিকাংশ খামারই খালি পড়ে আছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। হঠাৎ মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্তরা।

খামারিরা বলছেন, কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে বাচ্চার সংকট দেখা দিয়েছে। আর সরবরাহকারীরা বলছেন, জুন মাসের আগে মুরগির বাচ্চা সরবরাহ সম্ভব নয়।

সরেজমিনে খামার খরচ ও বাজারদর অনুসন্ধান করে জানা যায়, একটি ব্রয়লার মুরগি বিক্রির উপযুক্ত করতে ২৮-৩২ দিন সময় লাগে। এ সময় একটি মুরগির ওজন হয় গড়ে ১ হাজার ৮০০ গ্রাম হয়। প্রতি বস্তা মুরগির খাদ্যের দাম ৩ হাজার ৬৫০ টাকা।

২৮-৩২ দিনে একটি মুরগি আড়াই কেজি খাবার খায়। প্রতি কেজি খাবার ৭৩ টাকা হলে আড়াই কেজি খাদ্যের দাম পড়ে ১৮২ টাকা। বর্তমান বাজারে একটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ৮০ টাকা। শ্রমিক খরচ, বিদ্যুৎ বিল, মেডিসিন ও অন্য খরচসহ গড়ে প্রতিটি মুরগির পেছনে খরচ দাঁড়ায় ২০-২৫ টাকা। এ হিসাব করলে গড়ে ১৮০০ গ্রামের একটি মুরগির উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ২৮৭ টাকা, যা কেজি হিসাবে পড়ে ১৬০ টাকা। তবে কিছু খামারে মুরগির বাচ্চা বেশি মারা গেলে এর খরচ কিছুটা বাড়ে। কিন্তু খামারি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৫০ টাকা বা তারও বেশি।

উপজেলার ঢৌহাখলা ইউনিয়নের চুরালী গ্রামের এম এম হাসান পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিস ফিডের মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমার খামারে ৫২০টি ব্রয়লার মুরগি ছিল। গত মাসে ৫৬ টাকা করে বাচ্চাগুলো কিনেছি ২৯ হাজার ১২০ টাকায়। ৩ হাজার ৬৫০ টাকা দরে ২১ বস্তা খাবার দিয়েছি। যার দাম পড়েছে ৭৬ হাজার ৬৫০ টাকা। মেডিসিন সাড়ে ৩ হাজার টাকা, তুষ ৩ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিল ১৫০০ টাকা, লেবার খরচ ৫০০০ হাজার টাকা। মোট খরচ ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৭০ টাকা। আবার ৫০টি মুরগি মারা যায়। বাকি ৪৭০টি মুরগির ওজন গড়ে দাঁড়ায় ১৫০০ গ্রাম। গড়ে একটি মুরগির পেছনে খরচ পড়ে ২৫২ টাকা, যা কেজি হিসাবে হয় ১৬৮ টাকা।

রফিকুল আরও বলেন, ‘গত দেড় মাস ব্রয়লার মুরগির ব্যবসা করে কিছু টাকা লাভের মুখ দেখেছি। এবারের মুরগিগুলো ২১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। এখন শেড খালি খালি হয়ে আছে। ১০ দিন আগেই বাচ্চার বুকিং দিয়ে রেখেছি। কিন্তু বাচ্চা পাচ্ছি না। কোম্পানিগুলো বলছে বাচ্চার উৎপাদন কম। বাজার মূল্য ৬০-৬২ টাকা হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা করে। এবার যদি মুরগির বাচ্চা পাই, তাহলে ঈদে মুরগির দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে।’

একই ইউনিয়নের নন্দীগ্রামের খামারি শামসুল হক বলেন, ‘আমার খামারের মুরগির বয়স ২৬ দিন। ৩২ দিন হলে বাচ্চা বিক্রি করবো। ৫০০ মুরগির বাচ্চা ৬০ টাকা দরে কেনা ছিল। ৩২ দিনে প্রতি মুরগি গড়ে ১ হাজার ৭০০ গ্রাম ওজন হবে। তাহলে কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ১৬০ টাকা।

নন্দীগ্রামের নাইম পোল্ট্রি অ্যান্ড ফিশারিজ মালিক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন থেকে ৬ মাস আগেও মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ৮-১০ টাকা। মাস খানেকের ব্যবধানে দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। দু-তিন মাস ধরে খামারে মুরগি তোলা হয়নি। ঈদকে সামনে রেখে বাচ্চা খামারে তুলবো। বর্তমানে প্রতি বাচ্চার কোম্পানির মূল্য ৬০-৬২ টাকা হলেও ৮০ টাকার নিচে কেউ দিচ্ছে না।

নন্দীগ্রামের আরেক খামারি রফিক মিয়া বলেন, ‘চার দিন আগে মুরগির বাচ্চা ৮০ টাকা করে কিনে খামারে তুলেছি। বয়স ২৮-৩২ দিন হলে ১ হাজার ৭০০ গ্রাম থেকে ১ হাজার ৮০০ গ্রাম হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক খামারি বলেন, ‘মূলত মুরগির বাচ্চার সংকটের কারণেই ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। কোম্পানির মালিকরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমাদের মতো খামারির কাছ থেকে ব্যবসাটা তুলে নিবে। এমনটাও হতে পারে, কোম্পানির মালিকরা খামারিদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক ব্যবসা করবে। যেমন, আমাদের খামারে আমরা মুরগি লালনপালন করবো। তারা আমাদের মাসিক বেতন দেবে বা লালনপালন করার খরচ দেবে। মাস শেষে তারাই বিক্রি করে লাভের কিছু অংশ আমাদের দেবে। বাকিটা কোম্পানি মালিকরা নিয়ে যাবে। এমনটাই হবে, এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। কারণ এত টাকা খরচ করে আমরা এ ব্যবসা করতে পারবো না।

ময়মনসিংহ নগরীর মেছুয়া বাজারের মুরগি বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী  বলেন, বর্তমানে বাজারে ব্রয়লার মুরগি ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বাজারের যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে দাম আরও বাড়তে পারে।

গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়া বাজারের মুরগির বাচ্চার ডিলার এমদাদুল হক বলেন, আমি কিছুদিন আগে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ৬০-৬২ টাকা করে বিক্রি করেছি। তবে এখন কোম্পানি বাচ্চা দিচ্ছে না। তাই বর্তমান দামটা বলতে পারছি না।’ তবে কোম্পানির কোনো প্রতিনিধির ফোন নম্বর চাইলে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রভিটা কোম্পানির এক প্রতিনিধি ইকবাল হাসান  বলেন, বর্তমানে কোম্পানিতে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন নেই। ফলে আমাদের কোম্পানির বাচ্চা বাজারে নেই। অন্য কোম্পানির কিছু বাচ্চা আছে, তারা বিক্রি করছে। জুনে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা বাজারে আসতে পারে। তখন দাম কিছুটা কমতে পারে।