টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স নিয়ে চলছে কয়েক সহস্রাধিক ব্যাটারিচালিত মেট্রোরিকশা (ইজিবাইক)। সারাদেশে যখন ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাসহ সোচ্চার সবাই তখন এ ধরনের অবৈধ যানকে লাইসেন্স দিচ্ছে টাঙ্গাইল পৌরসভা। এত শহরে যেমন বেড়েছে যানজট তেমনি দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ সমস্যা। এতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে শহরবাসীর জীবন।

জানা যায়, ১৮৮৭ সালের ১ জুলাই স্থাপিত হয় টাঙ্গাইল পৌরসভা। যার বর্তমান আয়তন ২৯.৪৩ বর্গকিলোমিটার। ১৮টি ওয়ার্ডের প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভার মোট সড়ক সংখ্যা ৫৯০টি।

আরও পড়ুন- কৃষক ছানোয়ারের কলেজে শেখানো হয় কৃষির প্রতি ভালোবাসা

টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স বিভাগ জানায়, পৌরসভার লাইসেন্সপ্রাপ্ত অটোরিকশার সংখ্যা ৪ হাজার ৫০০, আর রিকশা রয়েছে ৫ হাজার। অটোরিকশা লাইসেন্স ফি ১০ হাজার ৫০০ আর প্যাডেলচালিত রিকশার লাইসেন্স ফি ১ হাজার টাকা।

সরেজমিন দেখা গেছে, ব্যাটারিচালিত ওই মেট্রোরিকশার পিছনে বা চালকের বসার সিটের নিচে সাঁটানো হয়েছে টাঙ্গাইল পৌরসভার লাইসেন্স। টাঙ্গাইল পৌরসভার বর্তমান মেয়র এস এম সিরাজুল হক আলমগীর স্বাক্ষরিত এক বছর মেয়াদি ওই লাইসেন্স ২০২১ সালে প্রথম দফায় অনুমোদিত। ফলে কিছু রিকশার লাইসেন্সের মেয়াদ দেখা গেছে ২০২১ থেকে ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত। অর্থাৎ লাইসেন্সের মেয়াদ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে।

দ্বিতীয় দফায় স্বাক্ষরিত রিকশার লাইসেন্সের মেয়াদ ২০২২ সাল থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত। এছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে এর আগেও তৎকালীন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র ৪ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দেন। শহরজুড়ে এ সময় লাগামহীন যানজট লেগে থাকায় ওই ৪ হাজার অটোরিকশা চলাচলে দুই শিফট চালু করা হয়। এরপর থেকে প্রতি শিফটে ২ হাজার করে অটোরিকশা চলাচল শুরু করে।

এদিকে এর ফাঁকে সড়কে নামতে শুরু করে ব্যাটারিচালিত মেট্রোরিকশা। বর্তমানে শহরজুড়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পাশাপাশি চলাচল করছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রোরিকশা। এছাড়া রয়েছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৫ হাজার প্যাডেলচালিত রিকশা। বর্তমানে অটোরিকশা দুই শিফটে চলাচল করলেও মেট্রোরিকশা চলছে দিনব্যাপী।

আরও পড়ুন- বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রাক উঠলেই বেড়ে যায় ওজন!

এছাড়াও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটবড় ১২৮টি পরিবহনসহ সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, বিমা, আদালতের যানবাহন ও ব্যক্তি মালিকাধীন গাড়িসহ গড়ে প্রতিদিন তিন সহস্রাধিক মোটরসাইকেল চলাচল করছে এই শহরে। ফলে শহরের প্রধান সড়কের বেবিস্ট্যান্ড, শান্তিমুঞ্জ মোড়, মেইন রোড, নিরালা মোড়, পার্কবাজার মোড়, ক্যাপসুল মার্কেট, পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, সুপারী বাগান মোড়, কলেজ গেট আর নতুন বাস টার্মিনাল এলাকায় রীতিমতো যানজট। যানজট নিরসনে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

চালক ও যাত্রীদের অভিযোগ, এর আগে পৌরসভা নির্ধারিত ১ হাজার ৫০০ টাকা ফি’র ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমান পৌর প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছর মেয়াদি প্যাডেলচালিত রিকশার ১ হাজার টাকার লাইসেন্স বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। মেট্রোরিকশার লাইসেন্সের কথা বলেও অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে পৌর প্রশাসনের কর্তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন বলে দাবি করেন তারা।

মেট্রোরিকশারচালক মো. পলাশ জানান, তিন বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছি। রিকশা ও গদি আটকে রেখে লাইসেন্স নিতে বাধ্য করা হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া চালানো যাচ্ছিল না বলেই লাইসেন্সটি নিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, ২০-২৫ হাজার টাকায় পৌরসভা থেকে লাইসেন্স বিক্রি হলেও দেড় মাস আগে মুসলিমপাড়ার একজন গ্যারেজ মিস্ত্রির মাধ্যমে ১২ হাজার টাকায় লাইসেন্স নিয়েছি। সুদের টাকায় রিকশা আর লাইসেন্সটি কিনেছি বলেও জানান তিনি।

মেট্রোরিকশাচালক মো. হযরত বলেন, ২০ হাজার টাকায় লাইসেন্সটি পেয়েছি। তার লাইসেন্স নম্বর ৮২৫। টাকা নিয়েছেন পৌরসভার লোকজন।

৪৯৯৫ নম্বর লাইসেন্সপ্রাপ্ত মেট্রোরিকশাচালক রফিক বলেন, ৪৩ হাজার টাকায় পুরোনো এ রিকশাটি কিনেছি। মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা ভাড়ায় লাইসেন্সটি নিয়েছি। লাইসেন্সটি পৌরসভা থেকে কিনেছেন আদি টাঙ্গাইল এলাকার রিকশার গ্যারেজ ব্যবসায়ী আকবর।

আরও পড়ুন- বিভিন্ন বিদ্যালয় ঘুরলেন ইউএনও, নিলেন ক্লাসও

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন ও যুবদের জন্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুঈদ হাসান তড়িৎ বলেন, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অবৈধ মেট্রোরিকশার বৈধতা দেওয়ার ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। দ্রুত অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুস সবুর বলেন, টাঙ্গাইল পৌরসভা থেকে চলাচলের জন্য ব্যাটারিচালিত মেট্রোরিকশাগুলো প্যাডেলচালিত রিকশার লাইসেন্স দিয়েছে। লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব তাদের নয়। পৌরসভার মেয়র এটা করেছেন। ব্যাটারিচালিত মেট্রোরিকশা আমাদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ লাইসেন্স দেওয়া নিয়েও আমাদের সঙ্গে কোনো মিটিং করেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। ইজিবাইক বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্যের বিষয়টি মেয়রের বলেও জানান তিনি।

টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস এম সিরাজুল হক আলমগীরের মুঠোফোনে কল তার পিএস সাজ্জাদ বলেন, এ ব্যাপারে সাক্ষাতে কথা বলা হবে বলে জানান তিনি।

২০২১ সালে সড়ক পরিবহন বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর সারাদেশে চলা অবৈধ ব্যাটারিচালিত ৪০ লাখ ইজিবাইক বন্ধের নির্দেশসহ আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আর অবৈধ ইজিবাইক আমদানি থেকে বিরত থাকতে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।