নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তাদের এ আন্দোলনে শরিক হয়েছে আরও কিছু রাজনৈতিক দল। এ দুইয়ের মিশেলে ‘যুগপৎ আন্দোলন’ নাম দিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তবে বিএনপির এ আন্দোলনে নেই তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত।

বিএনপির চলমান আন্দোলন কর্মসূচি সঠিকভাবে হচ্ছে না দাবি করে জামায়াত নেতারা বলছেন, তারা বিএনপির ভুল ভাঙার অপেক্ষায়। যদিও তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি চলমান দাবি করে নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী তা আরও বেগবান হবে।

আবার রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ বা কৌশল থেকে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে চূড়ান্ত আন্দোলনের আগেই বিএনপি আবার জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আবারও জামায়াত-বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে জামায়াত নেতারাও আশাবাদী। তারা বলছেন, কেউ যদি ভুল করে সে ভুল বুঝতে পারে তাহলে জামায়াত নিশ্চয়ই স্বাগত জানাবে।

আরও পড়ুন>> জামায়াত আমিরের বক্তব্যে বিএনপিতে অস্বস্তি

সূত্রের দাবি, চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার শেষ দিকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন নিয়ে সহিংসতায় জামায়াত ও ছাত্রশিবিবের কয়েকজন নেতাকর্মী নিহত হন। ওই সময় বিএনপির ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন জামায়াতের মধ্যে। ২০১৩ সালের আগস্টে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় প্রদান করেন। এরপর থেকে জামায়াত তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করার ক্ষমতাও হারায়। পাশাপাশি নেতাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানো ইস্যুতে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের অভিযোগ রয়েছে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে। ওই সময়কার আন্দোলনে বিএনপিকে জামায়াত তেমন একটা পাশে পায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

গত বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য বিএনপি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যেই ওই বছরের ২৭ আগস্ট জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণার ভিডিও ব্যাপক ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। তবে বছরের পর বছর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এ জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তায় নেই বিএনপি। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের খোলামেলা কথা হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে তাদের যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো আমরা।’

আরও পড়ুন>> জামায়াত-আওয়ামী লীগের পরকীয়া চলছে

যদিও এর কয়েকদিন পর গত ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক সভায় রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত ভেঙে দেওয়া হয়। পরে ১০ দফা দাবি আদায়ে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে গত ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওইদিন বিকেলেই জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন।

যুগপৎ কর্মসূচির প্রথমে গত ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিল পালনকালে রাজধানীর মৌচাকে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ ও জামায়াতের কয়েকজন নেতাকার্মী আহত হন। গ্রেফতার করা হয় দলটির কয়েকজন কর্মীকে। ওই ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া বা খোঁজখবর না নেওয়ায় জামায়াত নেতারা আবারও মনঃক্ষুণ্ন হন। এরপর থেকে আর কোনো যুগপৎ কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নেয়নি জামায়াত।

এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ‘জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পরকীয়া’ চলছে বলে মন্তব্য করেন। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এক সভায় বলেন, ‘‘আগে বলতো ‘বিএনপি-জামায়াত’, আর এখন বলে ‘আওয়ামী লীগ-জামায়াত’।’’

আরও পড়ুন>> বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কৌশল, যা ভাবছেন মিত্ররা

বিএনপির একলা চলো নীতি বা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য এবং শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হক বলেন, ‘বিএনপি কোন কৌশলে চলছে সেটা আমরা বুঝতে পারছি না, সামনে বোঝা যাবে। এতটুকু বুঝি, রাশেদ খান মেননের সারাদেশে ভোট নেই, জাতীয় পার্টির ভোট নেই, আওয়ামী লীগ তাদের ধরে রেখেছে।’

তিনি বলেন, ‘আগে যুগপৎ কর্মসূচি ছিল, একটা কমিটি ছিল, সেই কমিটি কর্মসূচি চূড়ান্ত করতো। এখন বিএনপি কর্মসূচি চূড়ান্ত করে মেসেজ (বার্তা) অন্যদের ফরওয়ার্ড করে দেয়, জামায়াতের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।’

আগে যেমন ‘বিএনপি-জামায়াত’ বলা হতো এখন বলা হচ্ছে ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের পরকীয়া’, ‘আওয়ামী লীগ-জামায়াত’- বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে মনিরামপুরের সাবেক এই উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সারাবছর কাজ করে, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে। এ ধরনের ফালতু কথা বলে না। বিএনপি নেতারা এ ধরনের ফালতু কথা তাদের পরিসরে বলেন, পরে আবার কেউ কেউ শুধরেও নেন।’

আরও পড়ুন>> যুগপৎ আন্দোলন মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে, দাবি ফখরুলের

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য আজিজুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি তাদের মতো করে কাজ করছে। প্রত্যেকটা দলের নিজস্ব লক্ষ্য-আদর্শ রয়েছে। একসময় জোট হয়েছিল এখন জোট নেই।’

ভবিষ্যতে আবার বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র, গণঅধিকার ইস্যুতে সবসময়ই জামায়াতের ভূমিকা রয়েছে। একসময় বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে জোটবদ্ধ হয়ে জামায়াত আন্দোলন করেছে। পরে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আবার ভিন্ন সুর তুলেছে। এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে গিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সামনে কী হয় সেটা বলা যাবে না।’

তবে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে কতটুকু আশাবাদী- এমন প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ  বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে শতভাগ সক্রিয় রয়েছে। তবে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি সঠিকভাবে হচ্ছে না।’

আর পড়ুন>> পথ হারিয়ে পদযাত্রা শুরু করেছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কীভাবে সঠিক হচ্ছে না বা ভুল কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা বিএনপি বলতে পারবে।’

সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনে আবারও জামায়াত-বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি ভুল করে সে ভুল বুঝতে পারে তাহলে জামায়াত নিশ্চয়ই স্বাগত জানাবে।’

জামায়াত নেতারা বলছেন, বিএনপি ভুল করছে এবং তারা বিএনপির ভুল ভাঙার অপেক্ষায় আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘জামায়াত তো আমাদের ঐক্যের মধ্যেই আছে।’ জামায়াত বিএনপিকে ছেড়ে আলাদা নির্বাচন করুক তাও চান না জমিরউদ্দিন সরকার।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘কে ভুল পথে আছে, আর কে সঠিক পথে আছে সেটা আন্দোলনই বলে দেবে। আমরা মনে করি, আমরা সঠিক পথে আছি, আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। এখন কেন তাদের মনে হচ্ছে আমরা ভুল পথে আছি সেটা তারা বলতে পারবে, আমরা বলতে পারবো না। তবে আমরা কোনো জোটে নেই, আমরা যুগপৎ আন্দোলনে আছি।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন হচ্ছে দুঃশাসনের অপসারণের বিরুদ্ধে। অনেকেই যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে। এখন জামায়াত যদি যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকতে চায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন তাদের যদি প্রশ্ন থাকে তারা আলাপ করতে পারে। এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।’