নগর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ সেবা চালু করেছিল বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। এক বছরের মাথায় এ সেবা কার্যক্রম অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট রুটে যথাসময়ে বাস পাচ্ছেন না যাত্রীরা। বাসের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা থাকলেও তা আরও কমেছে। যাত্রী ওঠা-নামানো হচ্ছে যত্রতত্র। টিকিট ছাড়াও তোলা হচ্ছে যাত্রী। তবে রেশনালাইজেশন কমিটি সংশ্লিষ্টদের দাবি, সব শৃঙ্খলার সঙ্গে চলছে।

যাত্রীদের অভিযোগ, নগর পরিবহনের প্রতিটি রুটেই গাড়ির সংকট রয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও বাস পাচ্ছেন না যাত্রীরা। বাসগুলো ঠিকমতো যাত্রী পরিবহন করছে কি না, তাও তদারকি করছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলেছে। বাধ্য হয়ে যাত্রীরা অন্য পরিবহনে যাতায়াত করছেন।

আরও পড়ুন>> প্রস্তুত হয়নি ২০০ বাস, নতুন ৩ রুটে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ চালু পেছালো

তবে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সংশ্লিষ্টদের দাবি, নগর পরিবহন শৃঙ্খলার সঙ্গে চলছে। দুই-একটা রুটে বাস সংকট রয়েছে। এজন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করার কাজ চলছে। বাস পেলে এই সংকট কেটে যাবে।

কিন্তু কবে বাস সংকট দূর হবে, যাত্রীরা যথাসময়ে বাস পাবেন তার কোনো উত্তর দিতে পারেনি বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি।

২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত (২১ নম্বর) একটি পাইলট রুট চালু হয়। এরপর ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর চালু হয় আরও দুটি রুট (২২ ও ২৬)। এখন ২৪ ও ২৫ নম্বর যাত্রাপথ চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে প্রতিটি রুটের যাত্রাপথ শুরু, গন্তব্য নগরের বিভিন্ন এলাকায়।

আরও পড়ুন>> সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’?

বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন সম্প্রতি  বলেন, নগর পরিবহনের প্রতিটি রুটেই স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারছেন যাত্রীরা। যাত্রীসেবার মান উন্নয়নে আমরা সব সময় তদারকি করছি। যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিচ্ছি।

তিনি বলেন, নগর পরিবহন চালু হওয়ার পর যাত্রী চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে বাসে আসন ফাঁকা থাকছে না। অনেকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন, এমনটা দেখেছি। এখন সবকটি রুটে বাস বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চলছে।

ঘাটারচর থেকে বছিলা, মোহাম্মদপুর, শংকর, ঝিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, মতিঝিল, হাটখোলা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, সানারপাড় হয়ে কাঁচপুর পর্যন্ত (২১ নম্বর রোড) চলে নগর পরিবহন। এই রুটের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই পথে ৫০টি বাস নিয়ে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। এর মধ্যে ৩০টি দ্বিতল বাস দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ও ২০টি বাস দিয়েছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সসিলভা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই রুটে পর্যায়ক্রমে ১০০টি বাস নামবে। ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকায় এই সেবা চালু হবে। কিন্তু এখন এই রুটে সব মিলে বাস চলে ৪০টি। বাকি ১০টি বাস বিভিন্ন ত্রুটির কারণে যাত্রী পরিবহন করছে না। নতুন বাস যোগ হয়নি।

আরও পড়ুন>> ঢাকা নগর পরিবহন: স্বস্তির পাশাপাশি মিলছে অভিযোগও

টিকাটুলি থেকে ধানমন্ডি নিয়মিত যাতায়াত করেন বেসরকারি চাকরিজীবী মনোয়ার হোসেন। বুধবার (১ মার্চ) সকালে নগর পরিবহনের বাসে তিনি অফিসে যান। আলাপকালে মনোয়ার হোসেন বলেন, নগর পরিবহন চালু হওয়ার মাসখানেক পর্যন্ত ভালো সেবা পাওয়া গেছে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, সেবার মান খারাপ হচ্ছে। কাউন্টারে গিয়ে ঠিকমতো বাস পাই না। অফিসের সময় গাদাগাদি করে যাত্রীরা বাসে ওঠেন। আসন না পেলে দাঁড়িয়ে অফিস যেতে হয়।

সায়েন্সল্যাব মোড়ে নগর পরিবহনের একটি বাসের যাত্রী মেহেদী হাসান  বলেন, এই রুটে চলাচল করা বাসগুলো দেরি করে আসে। অনেক ক্ষেত্রে বাস চলে আসার পরও টিকিট দিতে দেরি করে। বাসগুলো মোড়ে মোড়ে থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। এসব যাত্রীর ভাড়ার টাকা চালকের পকেটে যায়। এখন লোকাল বাস আর নগর পরিবহনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

শাহবাগে ২১ নম্বর রুটের কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা নাজিম বলেন, এই রুটে যাত্রীর তুলনায় বাস অনেক কম। তাই গাদাগাদি করে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হয়। বিষয়টি বারবার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু বাস বাড়ছে না। ফলে অনেক যাত্রী অন্য পরিবহনের বাসে যাতায়াত করছেন। নগর পরিবহন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

ঘাটারচর থেকে ওয়াশপুর-বসিলা-মোহাম্মদপুর টাউন হল-আসাদ গেট-ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার-শাহবাগ-কাকরাইল-ফকিরাপুল-মতিঝিল-টিকাটুলি-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-কোনাপাড়া হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত ২২ নম্বর রুট। এই রুটেও মাত্র ৫০টি বাস যাত্রী পরিবহন করছে। কিন্তু যাত্রীর তুলনায় এই রুটেও বাস অনেক কম বলে জানিয়েছেন যাত্রী এবং চালকেরা।

সম্প্রতি এসব এলাকা ঘুরে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস তেমন একটা চোখে পড়েনি। অনেকক্ষণ পরপর বিআরটিসির দ্বিতল এক-দুটি বাস যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। অফিসের সময় ছাড়া দিনের অন্য সময় প্রায় অর্ধেক আসনই থাকছে ফাঁকা। আর কাউন্টারগুলোতে যাত্রীদের চাপও কম।

মোহাম্মদপুর টাউন হল থেকে নগর পরিবহনে করে ফকিরাপুল নিয়মিত যাতায়াত করেন একটি ট্রাভেল এজেন্সির চাকুরে আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, নগরের অন্য পরিবহনের চেয়ে নগর পরিবহনের সেবা অনেক ভালো। কিন্তু কাউন্টারে গিয়ে এই পরিবহন সব সময় পাওয়া যায় না। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অফিস টাইমে টিকিট কেটে বাসে উঠলেও বসার আসন পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, সকাল ও বিকালে অনেক যাত্রী নগর পরিবহনে টিকিট না কেটেই ওঠেন। কিন্তু কাউন্টার থেকে যাত্রীদের তেমন কিছু বলে না। এমন অবস্থায় বাসে ভাড়া নেন বাস চালক। যেটা বেআইনি। কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি নজর দিতে হবে।

মতিঝিল কাউন্টারে ২২ নম্বর রুটের টিকিট বিক্রি করেন সারোয়ার। তিনি বলেন, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে প্রচুর লোকজন যাতায়াত করেন। বিশেষ করে অফিস সময়ে অনেকে টিকিট না কেটে বাসে উঠে যায়। পরে বাস থামিয়ে হলেও তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করি। তবে মাঝে মধ্যে অনেক চালক যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া তোলেন বলে শুনেছি। এর সত্যতা পাইনি।

বুধবার (১ মার্চ) দুপুর ১২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন যাত্রী ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছেন হাসপাতালটির সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসরাত জাহান। যাবেন শ্যামপুরের বাসায়। কিন্তু যাত্রী ছাউনিতে প্রায় ৩৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি বাস পাননি। জানতে চাইলে ইসরাত জাহান বলেন, নগর পরিবহনের সেবার মান ভালো। কিন্তু আমি এই স্টপেজে এসে দাঁড়িয়ে আছি ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। এখনো নগর পরিবহনের বাস আসেনি। দীর্ঘসময়ের এ অপেক্ষা হয়রানি ছাড়া তো আর কিছুই না।

কী পদক্ষেপ নিলে আপনাদের হয়রানি কমবে বলে মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ইসরাত জাহান জানান, যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা একেবারেই কম, বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি স্টপেই যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ ছুটি হলে যাত্রীর চাপ বেড়ে যায়। এসময় খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়। এতে নগর পরিবহনের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। যে সময়গুলোতে স্কুল-কলেজ ছুটি হয় ওই সময়গুলোতে যদি প্রতি ৫ থেকে ১০ মিনিট পরপর বাস যাতায়াত করে তাহলেই ভোগান্তি কমবে।

মো. শাকিল ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, আমার মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। তাকে নিয়ে প্রতিদিন আমার চার বার আসা-যাওয়া করতে হয় নগর পরিবহনে করে। সেবার মান ভালো, ভাড়াও কম। কিন্তু সেবার আড়ালে অনেক অনিয়ম হচ্ছে।

তিনি বলেন, আপনি দেখেন, এখানে ২০ থেকে ২৫ জনকে টিকিট দেওয়া হয়েছে। তার মানে ২৫ জনের টাকা সরকারের খাতে জমা হয়েছে। কিন্তু এখানে কি শুধু ২৫ জন মানুষ? কমপক্ষে ৩০-৩৫ জন হবে।

টিকিট নিয়ে বিড়ম্বনা বিষয়ে যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁনখারপুলে নগর পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা আসলাম বলেন, টিকিট দিতে আমাদের দেরি হচ্ছে না। যাত্রীরা চাইলেই আমরা তা দিচ্ছি। যাত্রীর চাপ থাকলে সমস্যা হয়।

১০মিনিট পর পর বাস আসার কথা থাকলেও এত দেরি হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিউমার্কেট এলাকায় সব সময়ই যানজট লেগে থাকে। তাই বাসগুলো আসতে কিছুটা দেরি হচ্ছে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ স্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ তাপস। তিনি বলেন, নগর পরিবহনে কিছু ব্যত্যয় আমরা লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে টিকিট না কেটে বাসে ওঠার একটা প্রবণতা আছে। সেটা কোনোভাবেই ঢাকা নগর পরিবহনে বরদাস্ত করা হবে না।

২৪ ও ২৫ নম্বর রুট চালুর প্রস্তুতি
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৬তম সভায় নগর পরিবহনের ২৪ ও ২৫ নম্বর যাত্রাপথ চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ২৪ নম্বর যাত্রাপথ হলো ঘাটারচর-বসিলা-মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড-শিশুমেলা-আগারগাঁও-মিরপুর ১০ দিয়ে কালশি ফ্লাইওভার হয়ে এয়ারপোর্ট-জসিমউদ্দীন- আব্দুল্লাহপুর যাবে। ২৫ নম্বর যাত্রাপথে ঘাটারচর-বসিলা-মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড-আসাদগেট-মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ দিয়ে খামারবাড়ি হয়ে বিজয় সরণি দিয়ে বের হয়ে জাহাঙ্গীর গেট-শাহীন স্কুল-মহাখালী (নিচ দিয়ে, ফ্লাইওভার হয়ে নয়)-বনানী উড়ালসেতু হয়ে রিজেন্সি-এয়ারপোর্ট-জসিমউদ্দীন রোড হয়ে আব্দুল্লাহপুর যাবে। এই দুই রুটে প্রাথমিকভাবে ৫০টি বাস চলবে।