তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর পেরিয়ে গেছে পাঁচদিন। ঘণ্টার হিসাবে ১২৫’র বেশি। তাই ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা লোকদের জীবিত উদ্ধারের আশা প্রায় ফুরিয়েই এসেছে। অথচ এখনো নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ। তাদের উদ্ধারে আরও সময় দরকার, যে জিনিসটা কারও হাতেই নেই। তাতে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছেন উদ্ধারকারীরা। আর জিতে যাচ্ছে মৃত্যু।
শনিবার (১১ ফেব্রুয়রি) মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, গত সোমবারের প্রলয়ংকরী ওই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে। তবে উদ্ধারকারীরা আটকেপড়া লোকদের উদ্ধারে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তুর্কি কর্তৃপক্ষ এবং সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের সবশেষ তথ্যমতে, দেশ দুটিতে এ পর্যন্ত ২৪ হাজার ৪৫৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ। এছাড়া, কেবল তুরস্কেই আহত হয়েছেন ৮০ হাজারের বেশি লোক।
আরও পড়ুন>> চারদিন পর মাসহ ১০ দিনের শিশু জীবিত উদ্ধার
তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (আফাদ) বরাতে আল-জাজিরা জানিয়েছে, দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ৬৬৫ জনে পৌঁছেছে। উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি উদ্ধারকর্মী।
অন্যদিকে, সিরিয়ায় এ পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ১২২ ঘণ্টা পর কাহরামানমারাস শহরে একটি ধসে পড়া ভবনের নিচ থেকে অলৌকিকভাবে জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৭০ বছর বয়সী এক নারী।
আরও পড়ুন>> থামছে না মৃত্যুর মিছিল, বাড়ছে আর্তনাদ
প্রথম ভূমিকম্পের প্রায় ১১০ ঘণ্টা পরে হাতায়ের মোস্তফা কামাল পাড়ায় একটি পাঁচতলা ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে। উদ্ধারকারীরা এখনো তার স্ত্রী এবং ছয় ও পাঁচ বছর বয়সী দুই সন্তানকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন>> ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কি সত্যিই সম্ভব?
গত সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্ক-সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ এক ভূমিকম্প। এর কয়েক ঘণ্টা পরে ফের ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয় ওই অঞ্চলে। এতে পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় তুরস্কের দক্ষিণ এবং সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল।
তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল থেকে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষকে।
আরও পড়ুন>> যে দৃশ্যে বুক কাঁপে
তবে সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিতে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে রাজনীতি বাদ দিয়ে সাহায্য বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, দুই দেশ মিলিয়ে অন্তত ৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষের জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। সোমবারের ভূমিকম্পের পর কেবল সিরিয়াতেই গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ৫৩ লাখে পৌঁছেছে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা
তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে নিয়োজিত উদ্ধারকর্মীরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের বের করে আনতে যত দেরি হবে, তাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা তত কমে আসবে বলে জানিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন>> তুরস্কে উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির জরুরি সেবা বিশেষজ্ঞ ড. রিচার্ড এডওয়ার্ড মুনের মতে, পানি এবং অক্সিজেনের স্বল্পতাই ভুক্তভোগীদের বেঁচে থাকার পথে প্রধান বাধা। তিনি বিবিসি’কে বলেছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর থেকে দৈনিক ১ দশমিক ২ লিটার পর্যন্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে। এটি ঘটতে পারে প্রস্রাব, নিঃশ্বাস, জলীয় বাষ্প এবং ঘামের মাধ্যমে।
তুরস্ক-সিরিয়ায় প্রথম ভূমিকম্প আঘাত হানার পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ দিন। ফলে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের শরীর থেকে এরই মধ্যে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে। এই অবস্থায় একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানিয়েছেন ড. রিচার্ড।
তার ওপর, সিরিয়া-তুরস্কে এখন চলছে শীতকাল। একজন গড়পড়তা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর উষ্ণ থাকার ক্ষমতা না হারিয়ে সর্বনিম্ন ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কিন্তু যখন শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, তখন গল্প ভিন্ন।
আরও পড়ুন>> বেঁচে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্মানো শিশুটি
ড. রিচার্ড বলেন, ওই মুহূর্তে শরীরের তাপমাত্রা মূলত পরিবেশের তাপমাত্রাকে অনুসরণ করে। এবং এটি যে হারে ঘটতে পারে তা নির্ভর করবে ব্যক্তির উষ্ণ থাকা বা ভূগর্ভে কতটা আশ্রয়ে থাকছেন তার ওপর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতভাগ্য অনেকেই হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।