ঢাকার ব্যস্ততম শিল্প এলাকা তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মোড় থেকে রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের প্রায় সবটাই দখলে। যতদূর চোখ যায় সারি সারি লেগুনা, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান দাঁড়িয়ে। এই সড়কে ছোট গাড়ি কিংবা রিকশা চলতেও অনেক সময় পড়তে হয় বাধার মুখে। যানজট নিত্যসঙ্গী। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নামে নামকরণ করা এই সড়কটি অবৈধ দখলদারদের থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনিই। তার মৃত্যুর পর ফের আগের অবস্থায় ফিরলেও নীরব ভূমিকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)।
সরেজমিনে তেজগাঁওয়ের সদা ব্যস্ত সড়কটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিজেদের মতো করে স্থায়ী স্ট্যান্ড বানিয়ে নিয়েছেন ট্রাক চালকেরা। ফলে সংকুচিত হয়ে পড়া সড়কে ফের যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ফিরেছে আগের চেহারা। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী।
ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের অনেক জায়গা আছে। সেখানে একটি মাল্টিপারপাস ট্রাক পার্কিংয়েরর জন্য জায়গা চেয়ে রেলওয়েতে আবেদন করেছি। তবে রেলওয়ে এখনো জায়গা বরাদ্দ দেয়নি। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী মাল্টিপারপাস ট্রাক পার্কিংয়ের নির্মাণকাজও শুরু করতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে শিগগির রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবো। তবে এখন সড়ক থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি ডিএনসিসি মেয়র।
এছাড়া ট্রাক-কাভার্ডভ্যানগুলো আড়াআড়িভাবে রাখায় গাড়ির পেছনের অংশ উঠে থাকছে ফুটপাতের ওপর। ফলে ফুটপাত দিয়ে পথচারীরাও হাঁটাচলার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফুটপাতের ওপরও তারা বসিয়েছে গাড়ি মেরামতের অস্থায়ী ওয়ার্কশপ। সেখানে চলছে ট্রাক মেরামতের কাজ।
কারওয়ান বাজার থেকে আনিসুল হক সড়ক হয়ে হেঁটে বেগুনবাড়ি যাচ্ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (মুদি দোকানি) আমিন হোসেন। তিনি বলেন, দোকানের কাজে প্রায়ই কারওয়ান বাজার যেতে হয়। এই পথটুকু রিকশায় যেতে গড়ে ৫০ টাকা ভাড়া লাগে। তাই অনেক সময় হেঁটেই যাই। তবে আনিসুল হক সড়কের ফুটপাত এবং সড়কে হাঁটারও পরিবেশ নেই। পুরো সড়কে ট্রাক, পিকআপ, লেগুনার দখলে চলে গেছে। বিশেষ করে বিকেল বা সন্ধ্যার পর দেখা যায় কোনো ট্রাক আড়াআড়িভাবে রাখায় রাস্তা সরু হয়ে জ্যাম তৈরি হয়। হেঁটে যাবো সেই সুযোগও থাকে না। আনিসুল হক সড়কে নিয়মিত রিকশা চালান জামাল মিয়া। এই সড়কে ট্রাকস্ট্যান্ড ও যানজটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনে চার লেনের এই সড়ক দুই লেনে ট্রাক পার্কিং করা থাকে। সন্ধ্যার পর চার লেনই ট্রাকের দখলে চলে যায়। ঠিকমতো রিকশাও চলাচল করতে পারে না।
মেয়র আনিসুল হক সড়কেই বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের প্রধান কার্যালয়। এই কার্যালয় এলাকায়ই সবচেয়ে বেশি ট্রাক রাস্তায় রাখা হয়। গত ২২ জানুয়ারি রাত ৮টায় এই সড়কে একটি কাভার্ডভ্যান পার্কিং করেন চালক মানিক। পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত একই স্থানে তার কাভার্ডভ্যান পার্কিংয়ে ছিল। কারণ জানতে চাইলে মানিক বলেন, ঢাকায় তো গাড়ি রাখার জায়গা নেই। এই রাস্তা ছাড়া অন্য কোথাও পার্কিং করলে পুলিশ মামলা দেবে। একানেই পার্কিং করা নিরাপদ। কোনো কোম্পানির মালামাল পরিবহনের অর্ডার পেলে চলে যাবো।
এসময় পাশে থাকা আরেক ট্রাকচালক শাহাদাত বলেন, প্রতিদিন রাতে ঢাকা শহরে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য হাজার হাজার ট্রাক ঢোকে। এর মধ্যে অধিকাংশ ট্রাক আবার মালামাল নিয়ে চলে যায়। বাকি ট্রাকগুলো আনিসুল হক সড়কে পার্কিং করে। তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা সরকারকে বলে আসছি আমাদের একটি স্থায়ী ট্রাকস্ট্যান্ড বানিয়ে দিতে। কিন্তু তারা আজও একটা ট্রাকস্ট্যান্ড বানাতে পারেনি।
বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি মো. মনির হোসেন তালুকদার বলেন, এই ট্রাকস্ট্যান্ড নিয়ে পাঁচ-সাত বছর ধরেই ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে। আমরা একটা সমাধান চাই। আমাদের জায়গা দেওয়া হলে স্ট্যান্ড করে রাস্তায় থাকা ট্রাক-ভ্যানগুলো সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। মেয়র আনিসুল হক সড়ক সাতরাস্তা হয়ে কারওয়ান বাজার, তেজতুরী বাজার, ফার্মগেট ও তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী, গুলশান, নিকেতন, হাতিরঝিল এবং রামপুরার সঙ্গে যুক্ত। ফার্মগেট-তেজগাঁও ঘিরে এক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া এ সড়ক হয়ে জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট, সংবাদপত্র ভবন, ছাপাখানা, প্রধান কার্যালয়সহ বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ এই সড়ক ব্যবহার করেন। এমন একটি সড়ক যানজটমুক্ত রাখতে না পারায় অনেকেই ডিএনসিসির আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর মেয়র আনিসুল হক সড়ক থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার কথা ছিল ডিএনসিসির। এই অভিযানে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস থাকায় এই কর্মসূচি স্থগিত করেন মেয়র। এরপর আর সড়কটিতে অভিযান চালানো হয়নি। জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা বলেন, এই সড়ক দখলের কারণে এখানে যে যানজট ও জনভোগান্তি হচ্ছে সেটা আমরা বুঝি। এখন আমরা চাচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভব ট্রাক টার্মিনালের জন্য একটা জায়গা দরকার। এ নিয়ে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছেন। ঠিক কবে জায়গা পাওয়া যাবে বা ট্রার্মিনাল কবে নির্মাণ করা হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি সেলিম রেজা।