রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে সংস্থাটি থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণের অনুমোদন নিতে হয়। এই কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করতে হয় রাজউকের ওয়েবসাইট। অনলাইনে নিবন্ধন করে ভবনের নকশাসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র গ্রাহককে এই ওয়েবসাইটেই আপলোড করতে হয়। পরে যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে এই ওয়েবসাইটেই ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও ভবনের নকশা আপলোড করে রাজউক। এগুলো ডাউনলোড করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেন গ্রাহক।
২০১৯ সালের মে মাস থেকে এমন আধুনিক পদ্ধতিতেই গ্রাহকদের সেবা দিয়ে আসছিল রাজউক। সংস্থাটির ওয়েবসাইটেও সব গ্রাহকের ভবনের তথ্য সংরক্ষিত ছিল। সম্প্রতি রাজউকের সার্ভার থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদনসংক্রান্ত প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের আবেদনের নথিপত্র গায়েব হয়ে গেছে। সংস্থাটি জানায়, ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেতে আবেদন করেছিলেন, এখন তাদের নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বিষয়টি জানতে এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠন করেনি রাজউক। এতে সংস্থাটির সদিচ্ছা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
গ্রাহকদের অভিযোগ, ৬ ডিসেম্বর হঠাৎ রাজউকের ওয়েবসাইট অকার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু এ ঘটনা নিছক কারিগরি ত্রুটি নাকি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জড়িত, সে বিষয়ে জানতে রাজউকের কোনো আগ্রহ নেই! অথচ এখন নতুন করে আবার আবেদন করতে গেলে দুর্নীতি, হয়রানির শিকার হতে হবে। রাজউকের এমন নীরব ভূমিকায়ই প্রশ্ন উঠেছে, তারা দুর্নীতি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে নথিপত্র গায়েব করেছে। তবে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এত সংখ্যক আবেদন কীভাবে গায়েব হলো তা নিয়ে এখনো তারা অন্ধকারে রয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব নথি পাওয়া না গেলে গ্রাহকরা নানা রকম ভোগান্তির শিকার হতে পারেন। তাই হারিয়ে যাওয়া সব নথি পুনরুদ্ধারে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ ঘটনায় থানায় জিডিও (সাধারণ ডায়েরি) করেছেন তারা।
গত ২৩ আগস্ট ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য রাজউকের প্রণয়ন করা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুমোদন দেয় সরকার। ড্যাপের নিয়ম অনুযায়ী, রাজউকের আওতাধীন অধিকাংশ এলাকায় আগের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে জমির মালিকদের। পরে জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক সিদ্ধান্ত নেয়, যারা ২৩ আগস্টের আগে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন তারা আগের নিয়মে ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। অর্থাৎ, বর্তমান ড্যাপে উল্লিখিত আয়তনের চেয়ে বেশি আয়তন পাবেন। গত ৪ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রাজউক। এর একদিন পরেই রাজউকের ভবন নির্মাণসংক্রান্ত ওয়েবসাইটটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ২৩ আগস্টের আগের তারিখে আবেদন দেখানোর জন্য একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজউকের ওয়েবসাইটটি অকার্যকর করতে পারে। ঘটনাটি তদন্ত করলেই তা বেরিয়ে আসবে। এখন পুরো নথিপত্র না পাওয়া গেলে গ্রাহকদের চরম হয়রানির মুখে পড়তে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হতে পারে।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করতে আগে সনাতন পদ্ধতিতে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণের অনুমোদন দিতো রাজউক। ২০১৮ সালে সব অঞ্চল অনলাইন (রাজউকের ওয়েবসাইট) ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দেওয়া শুরু করে সংস্থাটি। ২০১৯ সালের মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ অনুমোদনও অনলাইনে দেওয়ার কাজটি শুরু হয়। এজন্য ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন করতে হয় গ্রাহককে। ভবনের নকশাসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র গ্রাহককে এই ওয়েবসাইটেই আপলোড করতে হয়। পরে যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে এই ওয়েবসাইটেই ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও ভবনের নকশা আপলোড করা হয়। এগুলো ডাউনলোড করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেন গ্রাহক। কিন্তু রাজউক এখনো জানাতে পারেনি কেন ওয়েবসাইটটি অকার্যকর হয়েছিল এবং কেন নথিগুলো গায়েব হলো। এর মধ্যে ২২ ডিসেম্বর থেকে আগের ওয়েবসাইটেই নতুন করে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন নিচ্ছে রাজউক।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (টেকনোহ্যাভেন কোম্পানি লিমিটেড) সহযোগিতায় এই ওয়েবসাইট পরিচালনা করে রাজউক। জানতে চাইলে রাজউকের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট কাজী মোহাম্মদ মাহাবুবুল হক বলেন, গ্রাহকদের হারিয়ে যাওয়া তথ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। সব তথ্য পুনরুদ্ধারে একটু সময় লাগবে। কিন্তু ঠিক কতদিন সময় লাগবে তা তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আফতাবনগরে আট শতক আয়তনের একটি প্লটে ভবন নির্মাণের আবেদন করেছিলেন আতাহার আলী। যথাসময়ে আট তলা ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদনও পেয়েছেন। সম্প্রতি বিভিন্ন জনের মাধ্যমে নথি গায়েবের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) এ ঘটনার খোঁজ নিতে রাজউকেও যান। কিন্তু তাকে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।
আলাপকালে আতাহার আলী বলেন, ভবনের নকশা অনুমোদন নেওয়ার সময় এক কর্মকর্তাকে চার লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। এখন সেই নকশাই যদি সার্ভার থেকে গায়েব হয়ে যায়, তাহলে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কখন, কী অজুহাতে রাজউক অভিযান চালায় তার ঠিক নেই। তিনি বলেন, চলতি বছরের জুনে ছয়তলা বাড়ি নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি দুই তলা করার জন্য ব্যাংক লোন দরকার ছিল। এখন যদি সার্ভারে নথিই না থাকে, ব্যাংক লোন দেবে না। কারণ, ভবন বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নথিপত্র যাচাইয়ের জন্য রাজউকে চিঠি পাঠায়। এখন সার্ভারে নথি না থাকলে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ রাজউকের থাকছে না।জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, গ্রাহকদের হারিয়ে যাওয়া নথি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। এ ঘটনা তদন্তে কেন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, তার সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।