প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ ডিসেম্বর (বুধবার) মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। পরদিন থেকে গণমানুষের জন্য উন্মুক্ত হয় মেট্রোরেল। তবে প্রথম দিনে যেভাবে মেট্রোরেল থেকে আয় হয়েছে, দ্বিতীয় দিনে তার অর্ধেকও হয়নি। প্রথম দিনের থেকে দ্বিতীয় দিনে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৪০ টাকা আয় কমেছে। অথচ প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের ট্রিপ সংখ্যা ছিল একই, ৫০টি।

মেট্রোরেল ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করেছে। রাজধানীতে প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে মেট্রোরেল চলাচল শুরু করেছে। যানজটে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী দেখছে ব্যস্ত সড়কের মধ্যে পিলার বসিয়ে তৈরি উড়ালপথে ছুটে চলছে ট্রেন। মাত্র ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে উত্তরা থেকে আগারগাঁও চলাচল করছেন নগরবাসী।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়, প্রথম দিন সিঙ্গেল টিকিট বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ৯৯৬টি। প্রতি টিকিটের দাম ৬০ টাকা। মেট্রোরেলে যাতায়াতের জন্য ৩০৪টি এমআরটি পাস বিক্রি হয়। প্রতিটি পাসের দাম ৫০০ টাকা। এর মধ্যে কার্ডের জামানত ২০০ টাকা, বাকি ৩০০ টাকা ব্যালান্স, যা দিয়ে ভ্রমণ করা যাবে। আর কার্ড জমা দিলে জামানতের টাকা ফেরত দেবে সরকার। সব মিলিয়ে প্রথম দিনে মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫২০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়।

আরও পড়ুন>> তিন ঘণ্টা লাইনে থেকেও চড়া হলো না মেট্রোরেলে

তবে দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ শুক্রবার (৩০ ডিসেম্বর) মাত্র ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। অথচ দুই দিনই ট্রিপ সংখ্যা ছিল ৫০টি। অর্থাৎ আগারগাঁও থেকে উত্তরা স্টেশনে ২৫ বার এবং উত্তরা থেকে আগারগাঁও সমানসংখ্যক বার, মোট ৫০টি ট্রিপ হয়েছে আজ। প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে ট্রিপ সংখ্যা একই হলেও ভাড়া কমেছে অনেক। অথচ মেট্রোরেলে চড়তে না পেরে হাজারো মানুষ বাড়ি ফিরে গেছে।

আয় কমে যাওয়া প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএল জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে ট্রিপ সংখ্যা একই ছিল অথচ সরকারের আয় হয়েছে অনেক কম। এর প্রধান কারণ টিকিট বিক্রি মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়া। অনেকে টিকিট বিক্রয় মেশিনে ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোট দিয়েছেন, ফলে মেশিন আর টাকা ফেরত দেয়নি। অনেকে ছেড়া-ফাঁটা ও পুরাতন নোট দিয়েছেন, এতে করে মেশিন রিড আউট করতে পারেনি। এসব কারণে অনেক কোচ ফাঁকা গেছে, ফলে আয়ও কম হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমটিসিএল এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, ‌‘প্রথম দিনের থেকে দ্বিতীয় দিনে আয় কমেছে ২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। অথচ ৫০টি করে ট্রিপ হয়ে দুই দিনই। ট্রিপ সংখ্যা একই হলেও আয় কমেছে অনেক। কী কারণে আয় কমলো আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, মূলত মেশিন নষ্ট হওয়ার কারণে আয় কমেছে। সঠিক সময়ে টিকিট না সরবরাহ করায় অনেকে মেট্রোরেলে উঠতে পারেননি। অনেক আসন ফাঁকা গেছে। অনেকে ৫০০ টাকা এবং এক হাজার টাকার নোট দিয়েছেন মেশিনে। বার বার নোট দেওয়ায় মেশিন কাজ করতে পারেনি। অনেকে আবার ছেড়া ও পুরোনো নোট দিয়েছেন, এসব কারণেই মূলত মেশিন নষ্ট হয়েছে। ফলে আয় কম হয়েছে।’

আরও পড়ুন>> এবার উত্তরা স্টেশনেও ভেন্ডিং মেশিন বিকল

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এমআরটি পাসের দিকে বেশি নজর দিচ্ছি। এমআরটি পাস যত হবে ততবেশি আয় হবে। কারণ এমআরটি পাসে বার বার টিকিট মেশিনের ব্যবহার নেই। যাত্রীরা মেশিনে টিকিট সংগ্রহ ছাড়াই সহজেই মেট্রোরেল ভ্রমণ করতে পারবেন।’

প্রতিদিন মেট্রোরেল পরিচালনায় ব্যয় কত- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা টেকনিক্যাল বিষয়। এটা প্রকাশ করা যাবে না। তবে এটা বলতে পারি, মেট্রোরেলে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি।’

প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলমান প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, অনুমোদিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তবে মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বেড়ে গেছে। সেজন্য পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে আরও প্রায় এক বছরের বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে মেট্রোরেল প্রকল্পটি শেষ করতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর খরচ হবে আরও ১১ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার ঋণ থেকে ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। তবে কত বছরে এই ঋণ পরিশোধ হবে, দৈনিক মেট্রোরেলের পরিচালনা ব্যয় কত- এসব বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি ডিএমটিসিএল থেকে।

আরও পড়ুন>> ১০ মিনিটের মেট্রোরেলে চড়তে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা

এ প্রসঙ্গে শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএন সিদ্দিক বলেন, ‘দৈনিক আয়–ব্যয় বিবেচনা করে মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয়নি। বৃহত পরিকল্পনার কথা বিবেচনা করেই মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে। মেট্রোরেলে বছরে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে, বর্তমান রেটে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। ভাড়া কীভাবে নির্ধারণ করেছি আপনারা দেখেছেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটেই ভাড়া নির্ধারণ করেছি। সম্প্রতি যেসব দেশের সঙ্গে সঙ্গে তুলনা করবেন, তাদের বিদ্যুৎ রেট ও আমাদের বিদ্যুৎ রেটটি মাথায় রাখতে হবে। আমরা বলবো সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করেছি। এটা একদম সর্বনিম্ন ভাড়া। এই ভাড়া দিয়ে মেট্রোরেল লাভজনকভাবে পরিচালনা করা যাবে না। সেজন্য আমরা টিওডি ও স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করছি। সেখান থেকে আয় দিয়ে আমরা ট্রেন পরিচালনা করবো। কারণ আমরা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সাবসিটি দিচ্ছি।’

দৈনিক আয় ও ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যাত্রী থেকে যে আয় আসবে তা থেকে ৩০ শতাংশ পয়সা তুলতে পারবো না। কত বছরের মধ্যে ব্যয় তোলা হবে এটা বলা যাবে না। সবাই সিঙ্গেল টিকিট কাটলে ১০ শতাংশ বেশি পাবো। এছাড়া এমআরটি পাস টিকিট কাটলে ১০ শতাংশ কম পাবো। কারণ এই টিকিটে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এক মাস মেট্রোরেল চলাচল করলেই সব আয়-ব্যয় বলা যাবে, এখন কিছু বলা যাবে না।’

ডিএমটিসিএল জানায়, মেট্রোরেলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যমতে, এমআরটি-৬ লাইন চালু হলে দৈনিক যাতায়াতে যে সময় বাঁচবে তার আর্থিকমূল্য ৮ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা। একই সঙ্গে অন্যান্য যানবাহন পরিচালনার দৈনিক ব্যয় কমবে ১ দশমিক ১৮ কোটি টাকা।

এই হিসাবে এমআরটি-৬ চালুর পর এই দুই খাতে বার্ষিক ব্যয় সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকারও বেশি।

কোম্পানিটি আরও দাবি করেছে, বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল সেবা চালু হলে তরল জ্বালানি ও গ্যাসচালিত যানবাহনের সংখ্যাও কমবে সড়কে। এতে বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ কমবে দুই লাখ টনেরও বেশি।

আরও পড়ুন>> এক দশক অপেক্ষার পর স্বপ্নের মেট্রোরেল

বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক গণপরিবহন ব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করলো দেশ। মেট্রোরেলের একটি ট্রেন উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত একবার চালাতে ৭৫০ কিলোওয়াট থেকে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগবে। এজন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমসিটিএল) সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) দৈনিক ১৪ মেগাওয়াটের চুক্তি হয়েছে। ডেসকোর সঙ্গে ডিএমসিটিএলের উত্তরা প্রান্তে ৯ ও আগারগাঁও প্রান্তে ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত একবার চালাতে বিদ্যুৎ খরচ হবে ৭৫০ কিলোওয়াট থেকে ১ মেগাওয়াট। এটা নির্ভর করবে ট্রেনের গতি ও যাত্রী সংখ্যার ওপর।