অনেক আশঙ্কার মধ্যেও গত ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করেছে বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতাকর্মীদের গ্রেফতারেও থেমে থাকেনি সমাবেশ। ৩০ ডিসেম্বর সেই ঢাকায় আবার গণমিছিল কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। জেলা পর্যায়ের গণমিছিল খুব সুখকর ছিল না। ঢাকার কর্মসূচি ঘিরে তাই হামলা-মামলার আতঙ্কে কাটাচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। তবে যত বাধাই আসুক যে কোনো কৌশলে এই গণমিছিল সফলভাবে শেষ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিএনপি।
দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
নোয়াখালী-৫ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ বলেন, গত ২৪ ডিসেম্বর জেলা পর্যায়ে দলের প্রথম গণমিছিল কর্মসূচি পালনের আগে নোয়াখালী থেকেই একসঙ্গে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতির পর সেভাবে মামলা-হামলার শিকার না হলেও গত ৭ ডিসেম্বরের পর থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
আরও পড়ুন>> বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কৌশল, যা ভাবছেন মিত্ররা
‘অতীতে হামলা-মামলার মাধ্যমে বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সেগুলো এখনো করছে সরকার। তবে মুক্তিকামী নেতাকর্মীরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কৌশল অবলম্বন করে জয় নিশ্চিত করবে।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, গণমিছিল কর্মসূচির আগে নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় অংশ নিতে দেওয়া হয়েছে। ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার জন্যই হত্যা করা হয়েছে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বিএনপি নেতা আব্দুর রশিদ আরেফীনকে।
আরও পড়ুন>> বিএনপির সিনিয়র নেতাদের উচ্ছ্বাস, তৃণমূলে অবিশ্বাস!
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খানের দাবি, চেয়ারপারসন অফিসের স্টাফ, নিরাপত্তা সদস্য এমনকি ড্রাইভারও আসামি আছেন। মামলা সংখ্যা বর্তমানে দেড় লাখের কাছাকাছি। গ্রামের ওয়ার্ডে সদস্য থেকে শীর্ষ নেতা পর্যন্ত আসামি আছেন। কারও বিরুদ্ধে একশোর ওপর মামলা আছে।
বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, গত দুই মাসে সাড়ে তিনশোর অধিক মামলায় প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গত ৭ ডিসেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ১৫ জন।
আরও পড়ুন>> বিএনপি’র কূটনৈতিক তৎপরতা আন্দোলন নাকি নির্বাচনমুখী?
২৭ ডিসেম্বর ২০১২ থেকে সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির ৯১ গুরুত্বপূর্ণ নেতার নামে ১ হাজার ৭৫২ মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে ৩৬, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৫০, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ৯৩, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ৭, জমিরউদ্দিন সরকারের ৪, মাহবুবুর রহমানের ৩, রফিকুল ইসলাম মিয়ার ১৯, মির্জা আব্বাসের ৪৮, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ২৮, আব্দুল মঈন খান ১, নজরুল ইসলাম খান ৬, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ৬, সালাউদ্দিন আহমেদ ১২, বেগম সেলিমা রহমান ৪, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ৫, আমানউল্লাহ আমান ১৩৪, মিজানুর রহমান মিনু ১৮, জয়নুল আবদিন ফারুক ১২, হাবিবুর রহমান হাবিব ১৫, আব্দুল্লাহ আল নোমান ৫, মৃত শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ৪, মৃত সাদেক হোসেন খোকা ২৭, শাজাহান ওমর ৭, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ৫, আলতাফ হোসেন চৌধুরী ১১, বরকতউল্লা বুলু ৩৮, মো. শাহজাহান ১৭, মোসাদ্দেক আলী ফালু ৯, আব্দুল আউয়াল মিন্টু ৪, এ জেড এম জাহিদ হোসেন ১৭, শামসুজ্জামান দুদু ১১, আহমেদ আজম খান ৬, জয়নুল আবেদীন ১৮, নিতাই রায় চৌধুরী ৯, শওকত মাহমুদ ৫, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ৪২, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন ১৫, মজিবর রহমান সরোয়ার ১৪, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ১২৭, খায়রুল কবির খোকন ২১, হাবিবুর নবী খান সোহেল ১৮৯, হারুনুর রশিদ ১৪, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন ১৭, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুল ৪৭, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু ১৯, সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান হাবিব দুলু ১৪, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ২, বিলকিস জাহান শিরিন ১৭, শ্যামা ওবায়েদ ৫, বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন ২, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির নামে ৪৭ মামলা। এছাড়াও অনেক নেতার বিরুদ্ধে এক বা একাধিক মামলা রয়েছে।
সূত্রমতে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতারের পর নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। গ্রেফতার এড়াতে কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা রয়েছেন আত্মগোপনে। অনেকেই নিজ বাসায় রাতযাপন করছেন না।
আরও পড়ুন>> বিএনপির মনোনয়ন আলোচনায় জোবায়দা ও জাইমা রহমান
বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশে বিএনপির কর্মসূচিতে এর আগে ১৫ জন নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ গণমিছিল কর্মসূচিতে এলোপাতাড়ি মারধর ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদিঘি ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রশিদ আরেফিনকে। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় গণমিছিল চলাকালে অন্তত ৬০ জন নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, চার ধাপে আমাদের নেতৃত্বের শ্রেণিবিন্যাস হয়েছে। গ্রেফতার করেও নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি করা যাবে না। মামলা বাড়ছে। তা চলবে। কিন্তু মামলাই শেষ কথা নয়। মামলাকে আইনিভাবে মোকাবিলা করবো।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় তখন গ্রেফতার তো স্বাভাবিক ঘটনা। তখন টপ লেভেলের নেতাদের গ্রেফতারে তৃণমূল আরও জেগে ওঠে। আইয়ুব খানের সময় তাই দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের মহাদুর্যোগের সময় আমেনা বেগম নামে এক সাধারণ নারী দল পরিচালনা করেছেন। সংগঠিত সংগঠনে নেতৃত্ব সংকট তৈরি করা কঠিন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের গণসমাবেশ ঘিরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বর্বরোচিত ক্র্যাকডাউন চালিয়েছে, যা স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ চিন্তা করতে পারে না। অফিসে লুটপাট ও তছনছ করেছে। প্রায় সাড়ে চারশো নেতাকর্মীকে একসঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা ঢাকাসহ সারাদেশে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিল। গণসমাবেশ বানচাল করতে চেয়েছিল। রাস্তায় অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘট করেছে। ৯ জনের বেশি কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। তবুও কিন্তু আমাদের বিভাগীয় ও ঢাকার গণসমাবেশ পণ্ড করতে পারেনি। বরং জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল।
এই নেতা আরও বলেন, আজ মানুষ মাঠে নেমেছে। ২৪ ডিসেম্বর পুলিশ সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিয়েছে। পঞ্চগড়ে আবদুর রশিদ নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তবুও কিন্তু গণমিছিল ঠেকাতে পারেনি। ইনশাআল্লাহ ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিল সফল হবে।