কক্সবাজারে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির বা ক্যাম্পগুলোতে ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে খুনোখুনির তালিকা। চলতি মাসেই ক্যাম্পগুলোতে খুন হয়েছেন ৯ জন। গত ৫ মাসে এ সংখ্যা ঠেকেছে ২৫ জনে। এসব খুনের মামলায় যারা বাদী বা সাক্ষী হয়েছেন, তাদেরই পরবর্তী সময়ে খুন করা হয়েছে বলে দাবি রোহিঙ্গাদের। আবার খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক। এর ফলে চরম আতঙ্ক নিয়ে সময় পার করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে ক্যাম্পের আশপাশের স্থানীয়দেরও।

খুনের শিকার রোহিঙ্গাদের স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, ক্যাম্পে মাদক-অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়িতদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা বা কোনো মামলার সাক্ষী হলেই দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পড়ছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। এরপর যাকে তাদের বাধা মনে হচ্ছে, তাকে খুন করে ‘সরিয়ে দেওয়া’ হচ্ছে। আবার এমন অপরাধ করেও পাহাড় বেষ্টিত ক্যাম্প থেকে সহজে আত্মগোপনে চলে যেতে পারছে খুনীরা। এ কারণে খুন করার আগে তাদের তেমন ভাবতেও হচ্ছে না। আমাদেরই মাঝে একটি চক্র, অদৃশ্য ইশারায় অপরাধ ঘটাচ্ছে। আমাদেরই নির্যাতন করছে, কথায় কথায় খুন করছে। আমরা পুলিশকে এসব বিষয় জানিয়েছি। যারাই অপরাধীদের বিষয়ে জানিয়েছে, মামলার বাদী হয়েছে, স্বাক্ষী হয়েছে, তাদেরই টার্গেট করে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলছে  এ অবস্থায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের জীবনের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

সর্বশেষ গত ২৭ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) ভোরে কুতুপালং ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সি ব্লকের বাসিন্দা কেফায়েত উল্লাহর ছেলে আয়াত উল্লাহ (৪০) এবং মোহাম্মদ কাসিমের ছেলে ইয়াছিনকে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ভোরে ১৫-২০ জনের একদল দুর্বৃত্ত ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা আয়াত উল্লাহ এবং ইয়াছিনকে বাড়ি থেকে বাইরে এনে গুলি করে পালিয়ে যায়। এরপর ঘটনাস্থলেই ইয়াছিন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে আয়াত উল্লাহ মারা যান। এ নিয়ে ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (এডিআইজি) সৈয়দ হারুনুর রশিদ জানিয়েছেন, কে বা কারা, কেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কয়েকজনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

 ২০১৭ সালে মানবিকতার কারণে অনেকের ঘরের উঠানেও রোহিঙ্গাদের ঘর করে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেটাই এখন কাল হয়েছে স্থানীয়দের। ক্যাম্পের আশপাশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক স্থানীয় পরিবার। রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তদের কারণে নিজ দেশে পরবাসীর মতোই সন্ধ্যার পর প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হতে ভয় পান স্থানীয় মানুষ

তবে নিহত আয়াত উল্লাহর ভাই সালামত উল্লাহ জানান, তার ভাই ক্যাম্প-৫ ডিতে চাকরি করতো। পাশাপাশি ক্যাম্পের অপরাধীদের নানা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কথা বলতো, প্রশাসনকে সহযোগিতা করতো। এ কারণেই খুন হয়ে থাকতে পারে।

অন্যদিকে নিহত ইয়াছিনের ভাই হাছান জানান, নিহত আয়াত উল্লাহর এক ভাইয়ের হাত ও পা কেটে ফেলেছিল দুর্বৃত্তরা। তখন মাঝি ও পুলিশকে আমার ভাই ইয়াছিন সহযোগিতা করেছে। এখনো অপরাধীদের গতিবিধি সম্পর্কে নজর রেখে প্রশাসনকে জানাতো। হয়তো এজন্য দুর্বৃত্তরা টার্গেট করে আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। তারা ভাইকে মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কুপিয়েছে। আমাকেও ধরার চেষ্টা করেছিল, পালিয়ে গিয়ে আমি রক্ষা পেয়েছি। নিরাপদ থাকতে হলে ক্যাম্পে যৌথ অভিযান চালানো দরকার বলে দাবি করেন হাছান।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৫ মাসে (২৭ অক্টোবরের ২ জনসহ) খুনের শিকার হয়েছেন ২৫ জন। শুধু চলতি অক্টোবরেই ঘটেছে ৯টি খুনের ঘটনা।

গত ২৬ অক্টোবর ক্যাম্প ১০-এ খুন হন মোহাম্মদ জসিম। একই দিন মো. সালাম নামের অপর রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হন। ১৮ অক্টোবর ক্যাম্প ১৯-এ খুন হন সৈয়দ হোসেন। সৈয়দ হোসেনের পিতা জামাল হোসেন খুন হন ১০ অক্টোবর। পিতা হত্যার মামলায় বাদী হওয়া এবং আসামিদের ধরতে তৎপর থাকায় সৈয়দ হোসেনকে খুন করা হয় বলে মন্তব্য ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদের।

১৫ অক্টোবর ক্যাম্প ১৩ এর মাঝি মোহাম্মদ আনোয়ার ও সাব-মাঝি মোহাম্মদ ইউনুছকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১২ অক্টোবর হত্যা করা হয় ক্যাম্প ৯ এর সাব-মাঝি মোহাম্মদ হোসেনকে। ৪ অক্টোবর এবিপিএনের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে নিহত হয় তাসদিয়া আকতার (১১) নামের এক শিশু।

এর আগের ৪ মাসে খুন হন ১৬ জন। তাদের মধ্যে ২২ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এক রোহিঙ্গা নেতা। একই দিন (১ আগস্ট) উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।

১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, ১ জুন খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।

চলমান এই খুনোখুনি নিয়ে মধুরছড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা সালামত খান বলেন, আশ্রিত জীবনে একটু স্বস্তিতে থাকতে চাইলেও পারছি না। আমাদেরই মাঝে একটি চক্র, অদৃশ্য ইশারায় অপরাধ ঘটাচ্ছে। আমাদেরই নির্যাতন করছে, কথায় কথায় খুন করছে। আমরা পুলিশকে এসব বিষয় জানিয়েছি। যারাই অপরাধীদের বিষয়ে জানিয়েছে, মামলার বাদী হয়েছে, স্বাক্ষী হয়েছে, তাদেরই টার্গেট করে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলছে। আমরা নিরাপত্তা চাইছি, প্রয়োজনে সেনা টহল দেওয়া হোক।

চলমান নিরাপত্তা সংকট নিয়ে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের কুতুপালং এলাকার সদস্য প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, বিগত ৪-৫ মাস ধরে ক্যাম্পে খুনোখুনি, মারামারি, গোলাগুলিসহ নানা ধরনের অপরাধ চরমে পৌঁছেছে। নিরাপত্তা জোরদারের পরও প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্পে হত্যা বা হামলার ঘটনায় সব সময় সবাইকে আতঙ্কিত করে রাখছে। এটি বন্ধ হওয়া দরকার।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, পালংখালী ও উখিয়া ইউনিয়ন জুড়েই অধিকাংশ রোহিঙ্গার বসবাস। ২০১৭ সালে মানবিকতার কারণে অনেকের ঘরের উঠানেও রোহিঙ্গাদের ঘর করে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেটাই এখন কাল হয়েছে স্থানীয়দের। ক্যাম্পের আশপাশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক স্থানীয় পরিবার। রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তদের কারণে নিজ দেশে পরবাসীর মতোই সন্ধ্যার পর প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হতে ভয় পান স্থানীয় মানুষ। আমি নিজেও খুবই আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গাদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেখা যায়। চলার পথে হুট করে গুলি করে চলে গেলে করার কিছু থাকবে না।

তিনি বলেন, আশ্রয় শিবিরগুলো পাহাড় বেষ্টিত হওয়ায় অপরাধীরা দ্রুত গা-ঢাকা দিতে পারে। তাই পরিস্থিতি শান্ত করতে চাইলে যত দ্রুত সম্ভব কঠোর অভিযানে ক্যাম্পে অপরাধীদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা জরুরি। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালানো হোক। এরপরও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।

৮ এপিবিএনের (অপস অ্যান্ড মিডিয়া) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, ক্যাম্পে মাদক ও অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিরোধসহ নানা কারণে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি অপরাধীদের তথ্য প্রদান বা তাদের অপরাধকাণ্ডে কাউকে বাধা হিসেবে দেখলেও প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেও খুনোখুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে জোর তৎপরতা চলছে।

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ক্যাম্পে প্রতিটি খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারে এপিবিএন ও পুলিশ যৌথভাবে তৎপর রয়েছে। চলছে মামলার তদন্ত।

কক্সবাজারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ক্যাম্পের নিরাপত্তায় ৮, ১৪, ১৬ এই তিনটি এপিবিএন ব্যাটালিয়ন একাধিক ইউনিটে ভাগ হয়ে কাজ করছে। তাদের সফলতাও অনেক। কিন্তু পাহাড় বেষ্টিত আশ্রয় শিবির হওয়ায় অপরাধী শনাক্ত ও ধরা কষ্টকর। ক্যাম্প এলাকায় সামগ্রিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালানোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনা করা হবে।