রাজধানীর মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করেন মোস্তাক আহমেদ। বেতন পান সবমিলিয়ে ১৮ হাজার টাকা। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মিরপুরের কাজীপাড়ায়। বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত করেন তিনি। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মোস্তাক।

রোববার (৭ আগস্ট) আলাপকালে মোস্তাক আহমেদ বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এর ফলে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এছাড়া খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। কিন্তু সে অনুযায়ী চাকরিজীবী বা অন্যান্য পেশার লোকজনের আয় বাড়েনি। এমন অবস্থায় অনেকের জন্যই ঢাকায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে।

আরও পড়ুন>> বাসভাড়া বাড়লো মহানগরীতে প্রতি কিমি ৩৫, দূরপাল্লায় ৪০ পয়সা

মোস্তাক আহমেদ বলেন, বেতনের একটি বড় অংশ বাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারি না। নিজের পছন্দের খাবার বা পোশাক কেনা সম্ভব হয় না। মাস শেষ হওয়ার আগেই ধার-দেনা করতে চলতে হয়। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?

শুক্রবার (৫ আগস্ট) দিনগত মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রতি লিটার ডিজেলে বেড়েছে ৩৪ টাকা, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে বেড়েছে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে হচ্ছে ১১৪ টাকায়। এছাড়া প্রতি লিটার কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ ও পেট্রল ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আজ (রোববার) থেকে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা।

আরও পড়ুন>> জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে শাহবাগে অবস্থান

গুলশানে একটি সুপার শপে কাজ করেন সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা ইমদাদ হাসান। রোববার (৭ আগস্ট) সকালে আলাপকালে তিনি বলেন, ছাত্র অবস্থায় তিনটা টিউশনি করতাম। তখন মাসে আট-নয় হাজার টাকা আয় হতো। এই টাকার একাংশ দিয়ে মেসে থাকতাম। বাকি টাকা টাঙ্গাইলে বাড়িতে পাঠাতাম মা-বাবার হাত খরচের জন্য। এখন ১৪ হাজার টাকা বেতন পাই। কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্য বাড়ায় মেস ভাড়া, খাবার খরচ, পকেট খরচ দিয়ে মাস শেষে তেমন কিছুই থাকে না। বাড়িতেও ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারি না।

মহাখালীর আমতলী কাঁচাবাজার থেকে ৭০ টাকা দিয়ে একটি লাউ, ৬০ টাকা কেজিতে পটল ও করলা, ৩০ টাকা কেজিতে আলু কিনে বাসায় ফিরছিলেন সেকান্দার আলী।  তিনি জানান, তিনদিন আগেও এই বাজার থেকে শাকসবজি কিনেছেন আরও কম দামে। এখন তেলের দাম বাড়ায় প্রতিটি সবজিতেই পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন দোকানিরা।

তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়ায় শুধু কাঁচাবাজার নয়, জীবনযাত্রার সবক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে না খেয়ে দিন পার করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অপুষ্টিতে ভুগবে।

আরও পড়ুন>> লঞ্চভাড়া বাড়ানো নিয়ে সংকটে মালিকরা, প্রস্তাব যাচ্ছে আজ

বাড্ডা লিংক রোডে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিলেন সোহেল রানা। আলাপকালে তিনি জানান, পাইকারি বাজার থেকে তারা সবজি কিনে আনেন। পাইকাররা সব সবজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য তারাও সবজি কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তিনি বলেন, বেশি দামে সবজি বিক্রি করলেও আমাকেই আবার চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ বা মাংস বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দেশের সব মানুষ এমন চক্রাকারে আটকে গেছে।

তেলের দাম বাড়ায় মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম।  তিনি বলেন, জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রথমেই ধাক্কা খাবে পরিবহন সেক্টরে। আর পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সবই সম্পৃক্ত। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে বাড়বে পণ্যের দামও। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এই দাম আরও অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ আর ভালো থাকতে পারে না।