শিগগির জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উঠছে মেট্রোরেল প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব। এরই মধ্যে প্রস্তাবে সই করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে এক বছর। ব্যয় বাড়বে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। একই সঙ্গে দৈর্ঘ্য বাড়বে ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। মোট ব্যয় গিয়ে ঠেকবে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকায়।

এজন্য বর্তমান উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করছে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংশ্লিষ্টদের প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করা হয় পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে।

প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদ  বলেন, নানা কারণে নতুন করে চলমান মেট্রোরেল-৬ এ ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আমরা কয়েক দফা পিইসি সভা করেছি। এখন প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় ও সময় একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে। মূলত ভূমি অধিগ্রহণে বাড়তি ব্যয় ও সময় লাগছে। কারণ মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এক কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য বাড়ছে। খরচটা বাড়ছে মূলত এটার জন্যই।

তিনি আরও বলেন, এটা একনেক সভায় যাবে। মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় ডিএমটিসিএল ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) করতে চেয়েছিল, এটা বাদ দেওয়া হয়েছে। স্টেশনপ্লাজায় বেশি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল, এটাও কমিয়ে আনা হয়েছে। উন্নত দেশেও স্টেশনে কিছু কেনাকাটা করতে চায়, তাই দরকার অনুযায়ী বরাদ্দ রেখেছি।

উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ বলতে গেলে শেষ। চলতি বছরের ডিসেম্বরে এই অংশে মেট্রোরেল চলাচল উদ্বোধন করা হবে। কাজ চলছে প্রকল্পের বাকি অংশেও। তবে মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বেড়ে গেছে। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ধরে মেট্রোরেলের রুট দাঁড়াচ্ছে ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। কাজ বাড়ার কারণে বেড়েছে ব্যয়ও। ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পে নতুন ব্যয় ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বাড়ছে।

আগের প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুসারে, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকাই ছিল জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার ঋণের। বাকি টাকা সরকারি তহবিলের। নতুন করে যে ব্যয় বাড়ছে, সেখানে জোগানের জন্য জাইকা থেকে ঋণ চাওয়া হবে আরও তিন হাজার ৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা। সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হবে আট হাজার ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। নতুন অর্থ জাইকা দিলে তাদের ঋণ দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে সরকারি তহবিলের ব্যয় দাঁড়াবে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির প্রাথমিক মেয়াদকাল ছিল ১ জুলাই ২০১২ থেকে ৩০ জুন ২০২৪। তবে কাজ বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প শেষ করতে সময় লাগবে আরও এক বছর ছয় মাস। সেক্ষেত্রে এটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ ও ইঅ্যান্ডএম সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) জন্য ভূমি বরাদ্দ ও নকশা তৈরি, ট্রেন পরিচালনার বিদ্যুৎ খরচ এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি তৈরি, ফুটপাত নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলবে। এসবের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ছে।

পাশাপাশি উত্তরা সেন্টার স্টেশন কেন্দ্র করে একটি ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড হাব (টিওডি) নির্মাণ, স্টেশনপ্লাজাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এসব পরিকল্পনা অবশ্য প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে ছিল না।

মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় বাড়ার পেছনে শুল্ক ও ভ্যাট খাতকেও অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে ডিএমটিসিএল। সংস্থাটি বলছে, প্রকল্প ব্যয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় বিভিন্ন পণ্য, নির্মাণসামগ্রী ও সেবা ক্রয় বাবদ সরকারকে শুল্ক-কর দিতে গিয়ে। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণের পেছনেও একটা বড় ব্যয় হয়। সংশোধিত ডিপিপির প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের প্রায় ২৩ শতাংশই খরচ হচ্ছে শুল্ক-কর ও জমি অধিগ্রহণ খাতে। পরামর্শক খাতেও ব্যয় বাড়বে।

মেট্রোরেলের স্টেশন সংখ্যা বেড়ে ১৭টি
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন হওয়ার কথা ছিল। এখন নতুন করে কমলাপুরে একটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। স্টেশনের স্থানগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল।

প্রকল্পের অগ্রগতি
প্রকল্পের সবশেষ অগ্রগতি প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-৬) উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের সবশেষ সার্বিক গড় অগ্রগতি ৮০ দশমিক ১০ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৯২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৭৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৮১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এরই মধ্যে অর্ধেক মেট্রো ট্রেন বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে।

মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রুট আগামী ডিসেম্বরে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।