দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোতে মোটরসাইকেল চলাচল বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাবনা এসেছে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনাও চলছে। কেউ বলছেন, মহাসড়কে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার মূল কারণ দুই চাকার এই মোটরসাইকেল। এটিকে মহাসড়কে চলতে দেওয়া উচিত নয়। যদিও মোটরসাইকেল রাইডাররা বলছেন, সড়কে তাদের জন্য পৃথক লেনের দাবি বহুদিনের। সেটা না করে বন্ধ করে দিলে তা হবে ‘হাতের সমস্যায় হাত কেটে ফেলা’র মতো সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, এক্ষেত্রে জনসাধারণের চাওয়াকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারণ, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় আইন মানুষের কল্যাণে।
গত ১৯ জুন আসন্ন ঈদুল আজহা সামনে রেখে সড়কে যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে অংশীজনের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এতে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী ও বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার, বাস মালিক সমিতিসহ অংশীজন বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে গত ঈদুল ফিতরের সময় দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার পেছনে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলের বড় ভূমিকার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ অভিজ্ঞতা থেকেই আসন্ন ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোয় নিষেধাজ্ঞা চায় অনেকে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, মহাসড়কে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার কারণ মোটরসাইকেল। ঈদে সেটি আরও বেশি হয়। গত ঈদুল ফিতর তার দৃষ্টান্ত।
এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছে। অনেকে বলছেন, এটি মাথা ব্যথা সারাতে ‘মাথা কেটে ফেলার মতো’ সিদ্ধান্ত হবে। আবার কেউ বলছেন, তাহলে নসিমন করিমনও তো বলবে এ কথা। তাদেরও তো একই সমস্যার দরুন মহাসড়কে চলাচল করতে দেওয়া হয় না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল গলদ সিস্টেমে। মোটরসাইকেল আমদানির পথ খোলা, বিক্রি ও রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে হরদম। আবার এ-ও বলা হচ্ছে, মোটরসাইকেল অমুক জায়গায় চলবে, তমুক জায়গায় চলতে পারবে না। এগুলো তো পেশাদারত্ব নয়। সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ববান হতে হবে। তাদের ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। কর্তৃপক্ষকে সমস্যা তৈরি না করে বরং সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলতে দেওয়া যাবে না।
মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অ্যাপ-বেইজড ড্রাইভারস ইউনিয়ন অব বাংলাদেশের (ডিআরডিইউ) সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ বলেন, একটা বাহন যদি চলে, সেটা যদি যান্ত্রিক হয়, তাহলে তার জন্য রাস্তায় চলাচলের একটা ব্যবস্থা রাখা উচিত। যিনি বাইক নিয়ে চলাচল করবেন, তিনি মহাসড়কে উঠতে পারবেন না কেন? সড়কে বড় গাড়িগুলো তাদের পাত্তা দেয় না। তাই তো? এটার জন্য একটা লেনের ব্যবস্থা করতে আমরা বহু আগ থেকেই দাবি করে আসছি। সেটা না করে বন্ধ করে দেওয়ার কথা কেন আসছে? আপনার হাতে ব্যথা হলে কি হাতটা কেটে ফেলবেন?
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জন্য কেন রাইডারদের দায়ী করা হবে? এর ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ কেন হবে? আমি স্বীকার করছি যে, মোটরসাইকেল মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি এড়াতে আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই ইচ্ছেমতো বন্ধ করে দেবেন। এটা কেমন কথা?
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে কোনো দাবি তুলিনি। কারণ, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। বিআরটিএ এবার ফলো করছে, গত ঈদুল ফিতরে সারাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে। বিআরটিএ ইনিশিয়েটিভ নেবে। এটা আমাদের বিষয় নয়।
তিনি বলেন, ১৯ জুনের ওই বৈঠকে আমি ছিলাম না। তবে যারা ছিলেন তারা এমন প্রস্তাব দিচ্ছেন। মোটরসাইকেল বন্ধের প্রস্তাব কেন দেওয়া হচ্ছে, এটা আমি সুনির্দিষ্ট করে জানি না। বৈঠকে যারা ছিলেন, তারা বলতে পারবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানতে জাতীয় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছে বিআরটিএ। তবে সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সভায় অংশীজনরা আলোচনায় এনেছেন। আমরা এ প্রস্তাব দিইনি।
এ বিষয়ে বিআরটিএর পদক্ষেপ জানাতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে বিআরটিএর চাওয়ার কিছু নেই। আইন তো দেশের মানুষের জন্য। মানুষ যদি মহাসড়কে মোটরসাইকেল না চায় তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে এবং তা বাস্তবায়ন হবে। আমরা (বিআরটিএ) তো চাই, দেশে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটুক। সবাই আইন মানুক। কেউ তো আইন মানতে চায় না। আমরা সবকিছুই ভালো চাই। মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিরাপদ নয়, আমরা তো বিজ্ঞাপনও দিচ্ছি। কিন্তু দেশের আইনে তো সেটার নিষেধাজ্ঞা নেই। সেজন্য এ বিষয়ে জনমত আসছে, আমাদের অংশীজনরা সুপারিশ করেছেন। বিশেষত আসন্ন ঈদযাত্রায় এটার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে। এটি এখন সরকারের কাছে আছে। হয়তো পরে সিদ্ধান্ত হবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের বিষয়ে নানা সময়ে একেকজন একেক কথা বলেন। সেজন্য আমরা বসেছিলাম- সবাই কী ভাবে এটা বুঝতে। সবার বক্তব্য শুনেছি। ঈদযাত্রায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বা রাইড শেয়ারিং বন্ধের বিষয়ে সেদিনই আমরা সুপারিশ পেয়েছি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ বিষয়ে আরেকটি সভা করবো। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো।
তিনি বলেন, ‘একটা স্টাডিতে আমি দেখেছি, গত ঈদুল ফিতরে দেশের ৭০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলের কারণে। সেসময় সারাদেশে প্রায় ২ হাজার ৪০০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এর মধ্যে ৮০০ জনের মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এ কারণেই মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের দাবি সবার। তবে এ দাবির বিষয়ে তো আমরা একা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। এখানে স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আছে- সবাইকে জানিয়ে ও সবার মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য ২৫ জুনের পর এ বিষয়ে আরেকটি সভা করবো।’
তবে ঈদুর ফিতরের পর বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা বিআরটিএ যে তথ্য দেখিয়েছে তাতে উঠে এসেছে, ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরে ৯ মে থেকে ১৬ মে সাতদিনের ঈদযাত্রায় দেশে ৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮ জনের মৃত্যু হয়। প্রতিদিন গড়ে ৭ জন। আর চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ঈদুল ফিতরের ২৮ এপ্রিল থেকে ৫ মে আট দিনের ঈদযাত্রায় ১০৬টি দুর্ঘটনায় ১০৬ জন মারা গেছেন। সড়কে গড়ে প্রতিদিন ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২১৪ জনের মৃত্যু হয়। যা ওই বছর সড়কে মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দেশে সারাবছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ ও মৃত্যু বাড়ে ৫১ শতাংশ।
এ বছর ঈদুল ফিতর ঘিরে ১৪ দিনে (২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে) সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে রোড সেইফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, যাতায়াতের বিকল্প বাহন হিসেবে এবার ঈদে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে চড়ে বিভিন্ন জেলায় গেছেন। এসময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণ গেছে। এসময়ে দেশে মোট ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে দেড় হাজার যাত্রী। সে হিসাবে গত ঈদে মোট দুর্ঘটনার ৪৫ দশমিক ২২ শতাংশ মোটরসাইকেলে আর মোট মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশও দুই চাকার এ বাহনটিতে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আমাদের দেশে মোটরসাইকেল আমদানি পথ খোলা, অহরহ রেজিস্ট্রেশনও হচ্ছে। করোনার কারণে দেশের মোটরসাইকেল খাতে যে মন্দাভাব তৈরি হয়েছিল, খাতটি তা কাটিয়ে উঠছে। এখন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে বলে সবার টনক নড়ছে। আগে থেকেই কেন এসব বিষয়ে ভাবা হয়নি? যারা রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন, তারা যদি পেশাদার লোক হতেন তাহলে এ সমস্যাটাই সৃষ্টি হতো না। এখন বিজ্ঞানের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ; এরপরও যদি দুই চাকার যানের নেতিবাচক প্রভাব কেউ না জানে, তাহলে তো সমস্যা। বিআরটিএ সমস্যা তৈরি করে, গণপরিবহনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
তিনি বলেন, মোটরসাইকেলের এত পরিমাণ রেজিস্ট্রেশন শুরুতেই দেওয়া উচিত হয়নি। যেহেতু মানুষ বিকল্প পাচ্ছিল না, বিকল্প তৈরিও করেনি, যে কারণে দুই চাকার এ যান মানুষের চলাচলে সুবিধা এনে দিয়েছে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে এলোমেলো কিছু করে ফেললে এটা কখনোই সমস্যার সমাধান আনে না। শুরুতে কিছুদিন ঠিকঠাক মনে হলেও অচিরেই নানা সমস্যা তৈরি হয়।
তবে একইসঙ্গে এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ এটাও মনে করেন, মোটরসাইকেল আনমেনেজেবল। এটার ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। মোটরসাইকেল ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ, এ নিয়েও বিতর্ক নেই। এখানে ব্যবহারকারীরও দোষ নেই। কোনো শিশু যদি দিনের পর দিন লজেন্স খায়, অভিভাবক যদি সেই লজেন্স সাপ্লাইয়ার হন, তাহলে শিশুটির তো দোষ দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষের আসনে যিনি বসে আছেন তাকেই শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত। সে হিসেবে আমি বলবো, শহরাঞ্চলে মোটরসাইকেল চলাচল করলেও জাতীয় মহাসড়কে তা সম্পূর্ণ বেআইনি।