# সাড়ে ১২ কেজি এলপিজির মূল্য ১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
# বাজারে বর্তমানে বেসরকারি ১২ কেজি এলপিজির মূল্য ১ হাজার ২৪২ টাকা

দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১২ কেজি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য বর্তমানে যেখানে ১ হাজার ২৪২ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের (এলপিজিএল) সাড়ে ১২ কেজির এলপিজির মূল্য গ্রাহক পর্যায়ে ৫৯১ টাকা। তবে এর সুফল পায় না গ্রাহক। সিন্ডিকেট, ক্রস ফিলিং করে বেসরকারি কোম্পানির সিলিন্ডারে নিয়ে বিক্রিসহ রয়েছে নানান অভিযোগ। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, সরকারি পর্যায়ের এ এলপিজির দাম বাড়ালে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় কমবে।

 ২০২১ সালে এলপিজিএলের সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে ৫৯১ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। বর্তমানে ওই দর বলবৎ থাকলেও ভোক্তা পর্যায়ে সেই সুফল পৌঁছায় না’

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অপেক্ষাকৃত অর্ধেকের চেয়েও কমে এলপিজি বিক্রি করে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ক্ষতি পোষাতে নিজেদের সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) প্রস্তাব দিয়েছে এলপিজিএল। গত মে মাসে দেওয়া ওই চিঠিতে চারটি বিকল্প প্রস্তাবও দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

এলপিজিএল কর্তৃপক্ষ বলে আসছে, আগে সরকারি এলপি গ্যাসের মূল্য বিপিসি নির্ধারণ করলেও ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি এলপিজির মূল্যও নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি।

বিইআরসি বেসরকারি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের এলপিজির দাম সৌদি কার্গো প্রাইসের (সিপি) ওপর নির্ধারণ করে। অন্যদিকে এলপিজিএলের বোতলজাত গ্যাস আমদানি করতে হয় না বলে স্থানীয় মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল থেকে এলপিজিএলের সাড়ে ১২ কেজি গ্যাসের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে ৫৯১ টাকা নির্ধারণ করে। বর্তমানে ওই দর বলবৎ থাকলেও ভোক্তা পর্যায়ে সেই সুফল পৌঁছায় না। অন্যদিকে এ মূল্য নির্ধারণ করার সময় বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েলের সমান পরিবহন ব্যয় (ফ্রেইটপুল চার্জ) এবং কমিশন নিয়ে এলপিজিএলের সঙ্গে টানাপোড়েনও তৈরি হয়।

জানা যায়, এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এই দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরামকো। এটি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এই সৌদি সিপি ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করেছে বিইআরসি। ৩৫:৬৫ হিসাবে প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রণ হিসেবে গড় মূল্য নির্ধারণ করা হয়। চলতি মাসে (জুন) সৌদি আরামকোর প্রতি টন প্রোপেন ও বিউটেন ছিল ৭৫০ ডলার করে। এর আগে গত এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ দর ওঠে এলপিজির। ওই মাসে প্রতি টন প্রোপেন ৯৪০ ডলার এবং বিউটেন ৯৬০ ডলার হিসেবে বিক্রি হয় এলপিজি।

এদিকে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এলপিজির মূল্য প্রতি মাসের শুরুতে নির্ধারণ করে বিইআরসি। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এ দর নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি। সবশেষ গত ২ জুন বেসরকারি ১২ কেজির এলজিপির মূল্য ১ হাজার ২৪২ টাকা নির্ধারণ করে। এর আগে গত এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী দরের কারণে এখানেও ১২ কেজি এলপিজির মূল্য সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও সমন্বয় করা হয়।

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডে উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য আগে নির্ধারণ করতো অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বিপিসি। গত বছর সরকারি নির্দেশে এলপিজির দাম নির্ধারণ করছে বিইআরসি। সবশেষ ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বিপিসি প্রতি সাড়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে ৬শ টাকা। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ভোক্তা পর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার ৫৯১ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫৯১ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও খোদ এলপিজিএল কার্যালয়ের গেটেই ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রির তথ্য চাউর হয়। এ কারণে গত বছরের মাঝামাঝি প্ল্যান্ট গেটে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজি বিক্রি বন্ধ করে দেয় এলপিজিএল।

এদিকে গত ২২ মে বিইআরসিকে দেওয়া একটি চিঠি এসেছে হাতে। এলপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু হানিফ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ভোক্তা পর্যায়ে ৫৯১ টাকা মূল্য নির্ধারণের সময় ব্যয় বিভাজনে এলপি গ্যাস লিমিটেডের প্রদত্ত ছক অনুসরণ না হওয়ায় এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত এবং সিলিন্ডারের অবচয় বাবদ ব্যয় বাদ পড়ায় এলপি গ্যাস লিমিটেড আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপিসির অধীন এলপিজি বহনকারী কোম্পানির মার্জিন ও সমান পরিবহন ভাড়া (ফ্রেইটপুল) হ্রাস করায় বিপণন কোম্পানিগুলোও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

‘এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েল ও এলপিজির মূল্য বৃদ্ধি, এলপিজিএলের উৎপাদন ও প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি, বিপণনকারী কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েলের প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং কোম্পানিগুলোর বিক্রয় কমিশন ও সমান পরিবহন ভাড়া (ফ্রেইটপুল) বৃদ্ধি বিবেচনায় সরকারি পর্যায়ে এলপি গ্যাসের ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য বৃদ্ধি করা জরুরি প্রয়োজন।’

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিপিসি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েলের মূল্যসহ সব ব্যয় বিবেচনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত এলপি গ্যাসের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি পর্যায়ে এলপি গ্যাসের বিদ্যমান ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য ৫৯১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা প্রস্তাব করা হলো।

এছাড়া বিপণন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সৃষ্ট জটিলতা উত্তরণে এলপিজিএল ও বিপণন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নতুন মূল্য কাঠামো নির্ধারণেরও প্রস্তাব করা হয়। আবার মূল্য বাড়িয়ে মূল্য কাঠামোতে ব্যয় বিভাজন নির্ধারণের জন্য বিপিসিকে দায়িত্ব দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয় চিঠিতে।

এ ব্যাপারে এলপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু হানিফ বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। জ্বালানি বিক্রিতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু ক্রুড অয়েল পরিশোধন থেকে উপজাত হিসেবে পাওয়া এলপিজি কম দামে বিক্রির কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রের অর্থ। আবার এলপিজির মূল্য নির্ধারণের পর ব্যয় বিভাজন নিয়েও বিপণন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জটিলতার তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ফ্রেইটপুল চার্জ ও কমিশন নিয়ে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের সঙ্গে জটিলতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিইআরসির নির্দেশনা ছাড়া এসব সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। যে কারণে এলপিজির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১২ কেজির এলপিজি ১২শ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সেখানে আমাদেরগুলো ভোক্তা পর্যায়ে ৫৯১ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম বাড়ানো হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় কমবে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের কোথাও এলপিজিএলের এলপিজির সিলিন্ডার ৫৯১ টাকায় বিক্রি হয় না। গত মে মাসে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে একটি গোডাউনে এলপিজিএলের সিলিন্ডার থেকে ক্রস ফিলিং করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিলিন্ডারে ভর্তি করার সময় স্থানীয় প্রশাসন ধরে ফেলেছে। এসব অনিয়মে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ডিলার সিন্ডিকেট জড়িত। এতে ৫৯১ টাকার সুফল সিন্ডিকেট খেয়ে ফেলছে, ভোক্তারা পাচ্ছেন না। দাম বাড়ানো হলে এসব অনিয়ম দূর হবে।