টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশ কিছু এলাকা ডুবে গেছে। সড়ক, আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে হাসপাতালেও জমেছে হাঁটু পানি। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে বিপাকে পড়েছেন নগরবাসী।

শুক্র ও শনিবারের টানা বর্ষণে মহানগরীর কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া ডিসি রোড, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, শুলকবহর, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেইট, আগ্রাবাদ সিডিএ, হালিশহর, মোগলটুলি, ট্রাঙ্ক রোড, তালতলা, চাঁন্দগাও, খতিবের হাট, সিঅ্যান্ডবি কলোনি, ফিরিঙ্গিবাজার, আলকরণ, বাকলিয়া আবদুল লতিফ হাটখোলা সড়কে পানি জমেছে।

গত দুদিনের হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের কারণে এসব সড়কে যানবাহনও কম ছিল। বৃষ্টির কারণে সাধারণ মানুষ ঘর ছেড়ে বের হননি। তবে কর্মস্থলমুখী লোকজনকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে অনেক সড়কে সিএনজি অটোরিকশার স্বল্পতা ছিল। সকালে জলাবদ্ধতার কারণে মুরাদপুর এলাকার লোকজনকে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটেও কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে।

এদিকে, বহদ্দারহাট-লালখান বাজার আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারেও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় ফ্লাইওভারের ২নং গেটে বেশ কিছুক্ষণ পানি জমেছিল। সর্বশেষ শুক্রবার ফ্লাইওভারটিতে জলজট তৈরি হলে ওইদিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ফ্লাইওভারেই যানজট তৈরি হয়। এতে কয়েকশত যানবাহন আটকা পড়ে।

একইভাবে গত দুদিন আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালও পানিতে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে হাসপাতালের নিচতলায় হাঁটু সমান পানি জমায় রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই জলাবদ্ধতার এমন দুর্ভোগের জন্য অপরিকল্পিতভাবে খাল ভরাট করে রাখাকে দায়ী করছেন নগরবাসী। বিশেষ করে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ৫ বছর ধরে বাস্তবায়নাধীন ১০ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্পই তাদের বেশি করে ভোগাচ্ছে বলে অভিমত অনেকের।

নগরবাসীরা বলছেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প ছাড়াও বিভিন্ন খালে বাঁধ দিয়ে রাখার কারণে ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশংকা করছেন অনেকে। বর্তমানে সামান্য বৃষ্টিতে জলজটে শহরের সড়কে নামা লোকজনকে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হয়, তেমনই নিচু এলাকার কিছু বাসা বাড়িতে পানি ঢোকায় নগরবাসীকে পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভেোগ।

গত ৫ বছর ধরে সিডিএ ও পাউবো কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে ৪০টি স্লুইসগেট নির্মাণ শুরু করলেও তার একটিও পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের কোনো সুফলই পাচ্ছে না নগরবাসী। এ নিয়ে গত মে মাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রও। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান নির্মাণ প্রকল্পের জন্য খালের মুখে যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুলে দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।

আগ্রাবাদ থেকে লালখান বাজার ফ্লাইওভার হয়ে সিএনজি অটোরিকশা করে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় যাচ্ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, গভীর রাতেও ফ্লাইওভারের ওপরে পানি জমে আছে। নিচে জলাবদ্ধতার কারণে গাড়িতে চলাচল দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এখন দেখি ফ্লাইওভারের ওপরও একই অবস্থা।

ফ্লাইওভারে পানি নিষ্কাশনের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা অপ্রতুল এবং পানি নিষ্কাশনের পাইপের মুখগুলোতে বালি জমে পানি আটকে যাচ্ছে। এর ফলে ফ্লাইওভারেও জলজট তৈরি হয়েছে।

শনিবার সকালে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শ্যামল দে। হাসপাতালে পৌঁছে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমেই জলাবদ্ধতার জন্য তাকে বেকায়দায় পড়তে হয়। অবশেষে পানি মাড়িয়ে তাকে হাসপাতালের অভ্যন্তরে যেতে হয়েছে।

তিনি বলেন, এখানের নালা-কালভার্টগুলো ময়লা আবর্জনায় ভর্তি হয়ে আছে। আর এ কারণে পানি সহজে নিষ্কাশন হচ্ছে না। আবার জোয়ারের সময় পানি উপচে নিচু সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতা তৈরি করছে।

বাদুরতলা এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, হাঁটু পানি ডিঙিয়ে চকবাজার যেতে হয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যাচ্ছে। বর্ষা আরও তীব্র হলে তখন কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন! গত ক’বছর ধরে শুধু জলাবদ্ধতা নিরসন করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে বলে শুনছি। কিন্তু জলাবদ্ধতা কমছে না। এই জলাবদ্ধতা নিয়ে কখনো সিটি কর্পোরেশন সিডিএকে দোষারোপ করে, কখনো সিডিএ সিটি কর্পোরেশনকে দোষারোপ করে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৯ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএর নেওয়া ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের অনুমোদন পাওয়ার পর কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। একই বছরের ২৫ এপ্রিল ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণ’ প্রকল্পের অনুমোদন পায়। পরের বছর থেকে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু করে সংস্থাটি।

এছাড়াও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৯ সালে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাউবো আরেকটি প্রকল্পের অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যাপ্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণ করা হবে। সেটির কাজও চলমান রেখেছে পাউবো। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) বিভিন্ন সময় খাল-নালা পরিষ্কারে নিজস্বভাবে প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।