ভাঙনের কারণে দেশের নদীতীরের মানুষের কষ্টের সীমা নেই। বিশেষ করে যমুনাপাড়ের বাসিন্দাদের। সেখানে বাড়ছে দারিদ্র্য। ভাঙনে নিঃস্ব অনেক পরিবার। নদীগর্ভে চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। বিলীন হয়েছে অনেকের বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। জেলার একাংশের জনগোষ্ঠীকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগই দেয় না যমুনার ভাঙন। এসব সমস্যা মাথায় রেখে শতবর্ষী ডেল্টাপ্ল্যানের আওতায় পুরো যমুনা নদী ঘিরে সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার। তীর বাঁধাই করে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক করিডোর। প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাজ। ডেল্টাপ্ল্যানের আওতায় আছে ২৩০ কিলোমিটার নদী।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘যমুনা রিভার ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকল্পে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১০ হাজার ৭শ কোটি টাকা। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য শিগগির পাঠানো হবে পরিকল্পনা কমিশনে। একনেক সভায় পাস হলেই বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ঋণচুক্তি সই হবে।

সূত্র জানায়, প্রথমে মাস্টারপ্ল্যান, পরে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। নদীর দুই পাড় সংকুচিত করা হবে নদীশাসনের মাধ্যমে। যমুনা নদীর প্রস্থ কোথাও ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার, কোথাও ১৮ আবার কোথাও ২০ কিলোমিটার। এটাকে ছোট করে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকার মতো চার দশমিক ৮ কিলোমিটারে রূপ দেওয়া হবে। সেতু এলাকার মতো প্রস্থেও যেন পানিপ্রবাহে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য নদী খনন বাড়ানো হবে। পাশাপাশি নেওয়া হবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ।

নদীপাড় বাঁধাইয়ের মাধ্যমে বিরাট ফসলি ভূমি পাবে বাংলাদেশ। ওই পাড় সংরক্ষণ করে নানা ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল, ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। এছাড়া জমি ব্যবস্থাপনা করে বসতি স্থাপনসহ গড়ে তোলা হবে বনায়ন, টাউনশিপ, বাঁধ ও শিল্পনগরী।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে পাঁচ কিলোমিটার বাঁধাই করা হবে যমুনার দুই পাড়। এরপর পর্যায়ক্রমে সিরাজগঞ্জের যমুনা সেতুর উত্তর পাড় থেকে কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া ভারত সীমান্ত পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার ঘিরে ডেল্টাপ্ল্যানের আওতায় টাউনশিপ ও ইকোনমিক করিডোর গড়ে তোলা হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এটা ১৫ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প। কয়েকটি ধাপে এটা বাস্তবায়ন করা হবে। বাঁধাই হবে পুরো ২৩০ কিলোমিটার যমুনার পাড়। নদীর প্রস্থ দেখা গেছে ১২ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। আমরা ড্রেজিং ও পাড় বাঁধাইয়ের মাধ্যমে এটাকে ছোট করে বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকার মতো সমান করবো। বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকা দিয়ে পানিপ্রবাহে কিন্তু কোনো সমস্যা হয় না। যমুনার প্রস্থ ছোট করলে আমরা অনেক ফসলি জমি পাবো। তাছাড়া পাড় ঠিক করে বাঁধতে পারলে এমনিতেই নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে উঠবে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেল্টাপ্ল্যান বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ যমুনাকেন্দ্রিক এ প্রকল্প। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুমোদিত ব-দ্বীপ পরিকল্পনাকে সরকার দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে। এই লক্ষ্যে ‘সাপোর্ট টু দ্য ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য বাংলাদেশ ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর কাজ শুধু ডেল্টাপ্ল্যানের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তুত করা। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ৬৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ অক্টোবর ২০১৮ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২।

এরই মধ্যে এই সাপোর্টিং প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ৮০টি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্প, ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং গবেষণা বিষয়ক প্রকল্প। এগুলো বাস্তবায়নে ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের আওতায় বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার উপ-প্রকল্প পরিচালক মির্জা মো. মহিউদ্দিন বলেন, যেসব প্রকল্পের প্রস্তাবনা আমাদের হাতে আসছে এর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প হচ্ছে ‘যমুনা রিভার ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’। প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জ থেকে শুরু করে কুড়িগ্রাম (ভারত সীমান্ত) পর্যন্ত যমুনা নদীর পাড় নেদারল্যান্ডসের আদলে বাঁধাই করা হবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দারিদ্র্য নিরসন হবে, অন্যদিকে ফসলি জমির পরিমাণও বাড়বে। পুরো যমুনা নদীশাসন করা হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ, যমুনা নদীর প্রস্থ সরু করাসহ যমুনার দুই পাড়ে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সেক্টর গড়ে উঠবে। এটা কয়েকটি ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।