কয়েক দশক ধরে খরা মোকাবিলা করে আসছে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে প্রবল খরা। রংপুর অঞ্চলও খরার চূড়ান্ত ঝুঁকির মধ্যে। যেভাবে জলাধার, নদী-নালা দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে ঢাকা অঞ্চলও খরার ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ সমস্যা সমাধানে দেশের নদীনালা রক্ষা, জলধারা ভরাট হয়ে যাওয়া থেকে মুক্ত রাখা এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে পানির ন্যায্য হিস্সা বুঝে নেওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা।

 খরা মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রচুর পরিমাণে বনায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক যেসব বিষয় আছে, যেমন পার্শ্ববর্তী যেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে, সেটা কৌশলের মাধ্যমে হোক কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বজায় রেখে হোক, অন্তত শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। যদি সেটা সম্ভব হয়, তাহলে ওই নদীকে ভিত্তি করে আশপাশের অঞ্চলে অন্তত মাটির আর্দ্রতা রক্ষা হবে। ফলে কৃষিকাজে কিছুটা হলেও সুবিধা হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ বাংলাদেশের নদীগুলো ভারত ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশ থেকেই এসেছে। আমাদের নেগোসিয়েশনের কৌশল ও তাদের সদিচ্ছা- এই দুটোর ওপর নির্ভর করবে উত্তরাঞ্চলের কী হবে।

এ প্রসঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শুষ্ক মৌসুমে যখন পানি সরবরাহ কমে যায়, তখন খরা সৃষ্টি হয়। এই খরাটা অনেকটা বৃষ্টিপাত এবং নদীকেন্দ্রিক। এই যে বর্ষাকালে আমাদের অত্যধিক পানি আসে, সেগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে পারি না। কারণ, আমাদের যে জলাধারগুলো আছে, সেগুলো সংরক্ষণ না করার কারণে খরার সৃষ্টি হচ্ছে।

তিনি বলেন, খরার পাঁচ-ছয়টি সমাধান আছে। খরা থেকে বাঁচতে হলে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে, জমি অনাবাদি না রেখে কৃষিকাজ করতে হবে কিংবা আবাদ করতে হবে। পশুপালন করতে হবে। অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক অবকাঠামোর কথা চিন্তা করতে হবে।

 শুষ্ক মৌসুমে যখন পানি সরবরাহ কমে যায়, তখন খরা সৃষ্টি হয়। এ খরাটা অনেকটা বৃষ্টিপাত এবং নদীকেন্দ্রিক। এই যে বর্ষাকালে আমাদের অত্যধিক পানি আসে, সেগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে পারি না। কারণ, আমাদের যে জলাধারগুলো আছে, সেগুলো সংরক্ষণ না করার কারণে খরার সৃষ্টি হচ্ছে। খরার পাঁচ-ছয়টি সমাধান আছে। খরা থেকে বাঁচতে হলে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে, জমি অনাবাদি না রেখে কৃষিকাজ করতে হবে কিংবা আবাদ করতে হবে। পশুপালন করতে হবে। অর্থাৎ কৃষিভিত্তিক অবকাঠামোর কথা চিন্তা করতে হবে।

কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, শিল্পায়নের চেয়ে আমাদের কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। করোনাকালীন আমরা যেটা দেখেছি, সব বন্ধ থাকার কারণে পরিবেশে ভারসাম্য এসেছে। আমাদের শিল্পায়নের কারণে অর্থনৈতিক অগ্রগতিও যেমন হচ্ছে, তেমনি পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কৃষিভিত্তিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হয়। বনায়ন এবং পশুপালনভিত্তিক সমন্বিত উন্নয়নের কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে। কৃষি পরিবেশগত উন্নত পরিবেশ আমাদের খরার হুমকি হ্রাস করতে পারে। যেটাকে বলা হয় কৃষি পরিবেশগত উন্নতি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের জল সংরক্ষণ করতে হবে কিংবা জলাধার তৈরি করতে হবে। ভূপৃষ্ঠভিত্তিক সেচ উন্নয়ন করতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক জলাধার সংরক্ষণ, জলের ব্যবহার, প্রয়োজনে নতুন করে জলাধার সৃষ্টি করতে হবে। খরা নির্মূল করতে আগে পানি ধারণ করতে হবে। এই ধারণটা ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ দুই জায়গায় হতে হবে। কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। সব জায়গায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং এটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রিপন বলেন, খরার কারণে প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের কিছু এলাকা মরুকরণের দিকে যাচ্ছে; সেটি হলো রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর কিছু অংশ।

তিনি আরও বলেন, সারাবিশ্বে খরা মাপার জন্য যা ব্যবহার করা হয় তা হলো এসপিআই বা স্ট্যান্ডার্ডাইজড পিসিপিডেশন ইনডেক্স। এই ইনডেক্সে দেখা যাচ্ছে গত তিন দশকে রংপুর বিভাগে তিস্তা অধ্যুষিত এলাকা যেটা আছে, এই অঞ্চলের প্রবণতা একদম খরার ঝুঁকিতে অবস্থান করছে। যেকোনো সময় এ অঞ্চলের খরা প্রকাশ পেতে পারে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান রিপন বলেন, রাজশাহী অঞ্চল থেকে এ অঞ্চলের খরার একটা মূল পার্থক্য হলো রাজশাহী অঞ্চলে অতিমাত্রায় তাপমাত্রা। খরা বলতে সেটা একদম খরা। কিন্তু এই অঞ্চলে যখন খরা তখন খরাই থাকে, আবার যখন বর্ষা তখন বন্যা হচ্ছে।

তিনি বলেন, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল গঠনের পর তারা কিন্তু খরার সঙ্গে বিশেষ করে কৃষক সমাজ একটা পদক্ষেপের দিকে চলে গেছে। সেটি হলো খরার কারণে কী ধরনের ফসল করবে সেটা তারা পরিকল্পনা করেছে। কারণ, তারা জানেন এই সময়ে পানি পাবেন না। পানি সংকটের মধ্যে কোন ধরনের ফসল ফলাবে এ বিষয়গুলো কৃষি বর্ষপঞ্জি যেটাকে বলা হয়, তারা খরার সঙ্গে সেটি পরিকল্পনা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, যদি খরা দূর করতে হয়, তাহলে পানি প্রবাহিত রাখতে হবে। এজন্য প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট হতে দেওয়া যাবে না। এক সময় বাংলাদেশে কতো বিল ছিল। বিলগুলো কিন্তু আঁধার। আমাদের এখানে একটা চমৎকার ঘটনা ঘটে, সেটি হলো সারাবছরে বৃষ্টি হয় তিন মাস। বার্ষিক বৃষ্টি হয় ২০০ সেন্টিমিটার, তার ৯০ শতাংশেরও বেশি বৃষ্টি হয় এই তিন মাসে। বাকি মাসগুলো কিন্তু বৃষ্টি হয় না। এজন্য এই বৃষ্টির পানি আমাকে কোথাও না কোথাও ধরে রাখতে হবে। একটা সময়ে আমরা বিলগুলোতে ধরে রাখতে পারতাম। এমন কোনো গ্রাম ছিল না, যেখানে একটা করে বিল ছিল না। আমাদের এই ন্যাচারাল রিজার্ভার বা প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো, দখল হয়ে গেছে। সব তো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিন্তু যেটুকু আমাদের আছে, সেটুকু যেন ভরাট না হয় এটা প্রথম পদক্ষেপ। এটা কোনোভাবেই ভরাট হতে দেওয়া যাবে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের নদী বা খাল আছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর অল্পমাত্রায় হলেও খনন করছে। কাগজে-কলমে বেশি, কিন্তু বাস্তবে কম। এই খননকাজটা প্রতি বছর করতে হবে। নতুন করে বিল ভরাট করতে দেওয়া যাবে না।

বনায়ন সৃষ্টি ও জলাধার রক্ষায় জোর দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, খরা দূর করতে হলে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে হবে। আমরা যদি প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাই, তবে খরা প্রশমন সম্ভব। বর্ষাকালে যে পানি আসে, যদি আমরা জলাধার হিসেবে কোথাও ধরে রাখতে পারতাম, যদি বড় বড় রিজার্ভার তৈরি করে কিংবা খাল-বিল ড্রেজিং করে পানি ধরে রাখতাম, তবে শুষ্ক মৌসুমের কয়েক মাস খুব সহজেই সেচের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারতাম। বৃষ্টি কম হলেও অন্তত কৃষিকাজ তো করতে পারতাম। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো নদীর পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে পারি না।

পার্শ্ববর্তী দেশেগুলো থেকে পানির ন্যায্য অধিকার আদায় করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খরা মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রচুর পরিমাণে বনায়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক যেসব বিষয় আছে, যেমন পার্শ্ববর্তী যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে, সেটা কৌশলের মাধ্যমে হোক কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বজায় রেখে হোক, অন্তত শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। যদি সেটা সম্ভব হয়, তাহলে ওই নদীকে ভিত্তি করে আশপাশের অঞ্চলে অন্তত মাটির আর্দ্রতা রক্ষা হবে। ফলে কৃষিকাজে কিছুটা হলেও সুবিধা হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, বাংলাদেশের নদীগুলো ভারত ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশ থেকেই এসেছে। আমাদের নেগোসিয়েশনের কৌশল ও তাদের সদিচ্ছা- এই দুটোর ওপর নির্ভর করবে উত্তরাঞ্চলের কী হবে।