বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১৯১টি মিটারগেজ ও ৯২টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন) রয়েছে। মেকানিক্যাল কোড অনুযায়ী, অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে ১৮৩টির। এর মধ্যে ১৪০টি মিটারগেজ ও ৪৩টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন। এসব রেল ইঞ্জিন মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৯ সালে। তিন বছর হয়ে গেলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই প্রকল্প। উল্টো কাজ অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প শেষের পথে। একই সঙ্গে পুরোপুরি অকেজো হওয়ার পথে ইঞ্জিনগুলো।
বাংলাদেশে ১৯১টি এমজি রেল ইঞ্জিনের মধ্যে এমইএল-১৫ (২৭০০ সিরিজ) শ্রেণির ২১টি ইঞ্জিন ট্রেন চলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ইঞ্জিনগুলো প্রধানত চলতো মেইন লাইনে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২১টি রেল ইঞ্জিন মেরামত নিয়ে দুই ধরনের মত দেখা গেছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। একটি পক্ষ চায় প্রকল্পের আওতায় টেন্ডারের মাধ্যমে মেরামত করতে। অন্য পক্ষ চায় দেশীয় কারখানায় মেরামত করতে। তবে দেশীয় কারখানায় জনবল সংকট। বর্তমানে যে জনবল রয়েছে তা দিয়ে সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে হয়তো বছরে তিনটি ইঞ্জিন মেরামত সম্ভব। ফলে বাকি ইঞ্জিনগুলো দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় ব্যবহারের অনুপযোগী হতে পারে।
ওই ২১টি ইঞ্জিনের বয়স ২৫-২৬ বছর। এর মধ্যে চারটি কোনো রকম রেলপথে আর বাকিগুলো বিভিন্ন ওয়ার্কশপে দীর্ঘ চার বছর ধরে ধুঁকছে। দ্রুত সময়ে ইঞ্জিনগুলো মেরামত করলে আরও ১৫-২০ বছর সেবা দিতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ২১টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ নবরূপায়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১৯ সালে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রেলের ইঞ্জিনগুলো মেরামত করার পরিকল্পনা ছিল। যাতে ব্যয়ে ধরা হয়েছিল ২৪২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে ৬ লাখ টাকা অনুমোদন দিয়ে প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু অগ্রগতি কিছুই হয়নি।
রেলওয়ে জানায়, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রকল্পের প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিক্রি হয় ১৪টি টেন্ডার ডকুমেন্ট। দরপত্র খোলার তারিখ পাঁচবার পরিবর্তন হলেও দাখিল হয় মাত্র একটি। দরপত্র জমাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি টেকনিক্যালি নন-রেসপনসিভ হওয়ায় পুনঃদরপত্রের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীসময়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এবার ১০টি টেন্ডার ডকুমেন্ট বিক্রি হলেও কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করেনি। এরপর তৃতীয়বারের মতো একই বছরের মে মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এবারও কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দাখিল করা হয়নি দরপত্র।
দরদাতা না পাওয়ায় ২০২১ সালের নভেম্বরে রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের সভাপতিত্বে সভা হয়। এরপরই প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় অসমাপ্ত রেখে শেষ করার প্রস্তাব করেন প্রকল্প পরিচালক।
পরবর্তীসময়ে চলতি বছরের (২০২২) গত ২ ফেব্রুয়ারি স্টিয়ারিং কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিদ্যমান নিয়ম মেনে প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখে শেষ করে দেওয়ার।
রেলওয়ে জানায়, ওই ২১টি লোকোমোটিভ বা রেল ইঞ্জিন ১৯৯৫ সালে জার্মানির এবিবি হেনসেল থেকে সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কানাডিয়ান কোম্পানির মাধ্যমে অধিকৃত। ফলে এসব ইঞ্জিনের কম্পোনেন্ট ও স্পেয়ার পার্টস পাওয়া দুর্লভ। নবরূপায়ণ করে পুরোপুরি আগের আদল দেওয়াও সম্ভব নয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর তিনটি করে মেরামত করলেও ১৮টি লোকোমোটিভ মেরামতের জন্য প্রায় ছয় বছর সময় প্রয়োজন।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (উন্নয়ন) মো. হাসান মনসুর বলেন, ২১টি রেল ইঞ্জিন আমাদের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই প্রকল্প গ্রহণ করা। তবে কেউ কেউ চাচ্ছেন প্রকল্প বাদ দিয়ে নিজেদের কারখানায় এগুলো মেরামত করতে। আমার মতামত ছিল প্রকল্পের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় এগুলো দ্রুত মেরামত করা। কারণ বিদেশি কোম্পানি দিয়ে মেরামত করালে সময় কম লাগবে। ফলে অনেক দিন সেবা দিতে পারবে ইঞ্জিনগুলো।
দেশীয় কারখানায় রেল ইঞ্জিন মেরামতের বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সময় লাগবে দীর্ঘদিন। কারণ দেশীয় কারখানায় আমাদের সক্ষমতা কম। কারখানায় বছরে তিনটির বেশি ইঞ্জিন মেরামত করা সম্ভব নয়।