ইলিশ খান। আসেন। পদ্মার তাজা ইলিশ। প্রায় সারাদিন এমন হাঁকডাকে সরব থাকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাট। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় জমান ইলিশ খেতে। সঙ্গে পদ্মা সেতুসহ আশপাশের স্পট ঘোরা। রাত-বিরাতেও জমজমাট থাকে ঘাট এলাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে ঘাট থাকবে না। তখনও মানুষ এভাবে আসবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সেখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক-শ্রমিকরা।
অধিকাংশই মনে করেন, সেতু চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার এ নৌপথ গুরুত্ব হারাবে। তাতে অনেকটা যাত্রীশূন্য হয়ে পড়বে ঘাটগুলো। কমে যাবে হোটেল-রেস্তোরাঁর গ্রাহকও। টান পড়বে তাদের রুটি-রুজিতে
তবে কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকের মত ভিন্ন। তাদের ভাষ্য, ২০২০ সালের মার্চে পদ্মা সেতু কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর থেকে মাওয়া এলাকায় রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক আসছে। ওই সময় থেকে পদ্মা ঘাটকেন্দ্রিক খাবারের ব্যবসা বেশি জমেছে। সেতু চালুর পরে নৌঘাটের কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও থাকবে পর্যটক। তারাই এখন ওই এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁর মূল গ্রাহক।
শিমুলিয়া ঘাটে আলিফ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক আলিম খান বলেন, ইলিশ খাওয়ার জন্য এখন ঢাকা থেকে যত মানুষ আসে, ততটা ঘাটের মানুষও খায় না। সেতু চালু হলেও এ এলাকায় মানুষ ঘুরতে আসবে। মাওয়া ঘাট পর্যটনকেন্দ্র হবে। সেজন্য দুশ্চিন্তা করছি না।
ঘাট এলাকার বাইরে সুপার স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। এই রেস্তোরাঁর ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন বলেন, ঘাটের বাইরে এসব বড় হোটেলে নৌপথের যাত্রী আসে কম। যারা আসেন তারা পর্যটক। সেতু চালুর পরেও মানুষ আসবে ইলিশ খেতে।
তিনি বলেন, সেতুর কারণে দেশের সেরা রাস্তা হয়েছে এ পর্যন্ত। এখন এক ঘণ্টায় ঢাকা থেকে মাওয়া এসে তাজা ইলিশ খেতে পারছে মানুষ। সেটা থাকবে।
শিমুলিয়া-রানীগাঁও হোটেল সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফয়সল খান বলেন, এ অঞ্চল পর্যটন এলাকা হবে। তখন গ্রাহকের সংকট হবে বলে মনে হয় না।
তবে নৌপথের যাত্রীদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছোট ও মাঝারি হোটেলগুলো রয়েছে দুশ্চিন্তায়। শুধু শিমুলিয়া ঘাট নয়, নদীর ওপাড়ে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ি, শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরকান্দি নতুন ও পুরাতন ফেরি, লঞ্চঘাটেও শত শত হোটেল এবং অন্যান্য খাবারের দোকান অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
মাওয়া ঘাটের কস্তুরী হোটেলের মালিক ফরিদ উদ্দিন বলেন, ঘাটে মানুষ না এলে এসব হোটেল দিয়ে কী হবে? সবাই সেতু দিয়ে যাবে। সেতু এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার। এখানে খেতে আসবে কে?
তিনি বলেন, তখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি যেতে হবে। বাপ-দাদার ব্যবসা। তখন কী করে খাবো কে জানে।
শিমুলিয়া ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. মুরাদ খান। তিনিও মনে করেন ঘাট এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো কঠিন সংকটে পড়বে।
মো. মুরাদ খান বলেন, যাত্রী না থাকলে ঘাটের সন্নিকটের হোটেল রেস্তোরাঁগুলোর খুব সমস্যা হবে। সেগুলো গ্রাহক পাবে না। মাওয়া থেকে ওপাড়ে লঞ্চ ও ফেরিঘাটকেন্দ্রিক অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ। সেগুলো আরও সমস্যায় পড়েছে। এরই মধ্যে মাঝিরকান্দি পুরোনো ঘাটের অনেক হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে।
মুরাদ খান আরও বলেন, চালু রাখলেও যাত্রী কমে গেলে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লোকসানে যাবে। তখন বাধ্য হয়ে মালিক বন্ধ করে দেবেন। এজন্য সবাই দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছে।
মাঝিরকান্দি নতুন ফেরিঘাট এলাকায় ঢাকা হোটেলের মালিক জামাল হোসেন বলেন, দুই বছর আগে পুরোনো ঘাটে ফেরি বন্ধ হয়ে গেলো। তখন হোটেল সরিয়ে নতুন ঘাটে এলাম। এখন এখানেও অনিশ্চয়তা। পথে বসতে হবে ভবিষ্যতে।
দু’পাড়ের এমন আরও কয়েকজন হোটেল মালিক জানিয়েছেন, এরই মধ্যে অনেকে কর্মী ছাঁটাই করেছেন। ছোট ছোট বেশ কিছু খাবার বিক্রেতার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
খালেক হোটেলের মালিক খালেকুজ্জামান বলেন, সেতু চালুর পর পর্যটনকেন্দ্র হলেও এত গ্রাহক কখনো হবে না। যে যাই বলুক, যাত্রীর অভাবে ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে স্বাভাবিক নিয়মে। তখন আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। কীভাবে পরিবার চলবে সে চিন্তায় ঘুম হয় না।
বেশ কিছু ব্যবসায়ী এজন্য সরকারকে সেতু এলাকায় জমি বরাদ্দ দিয়ে হাইওয়ে রেস্তোরাঁ বসানোর সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানান।
গ্রাম-বাংলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের সেতুর স্টেশনে বা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে জায়গা দেওয়া হোক। সেখানে আমরা ব্যবসা করি। তাতে এত মানুষ বেকার হওয়া থেকে বাঁচবে।
শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁ নয়, দুই পাড়ে শত শত কনফেকশনারি, ফলের দোকান, চায়ের দোকান রয়েছে। এছাড়া পান, ঝালমুড়ি, বাদাম, সেদ্ধ ডিম, শিঙাড়া, শসাসহ নানা রকম মুখরোচক খাবারের স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা রয়েছেন কয়েক হাজার। ঘাট অচল হয়ে পড়লে কর্মসংস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারাও।