ভোগান্তির অপর নাম দৌলতদিয়া ঘাট। কিন্তু হঠাৎ পাল্টে গেছে দৌলতদিয়া ঘাটের চিরচেনা চিত্র। ঢাকামুখী যানবাহনকে এখন সিরিয়ালে থাকতে হচ্ছে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো এখন সরাসরি ফেরির দেখা পাচ্ছে। এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন যাত্রী ও চালকরা। তবে যানবাহন কমে যাওয়ায় আয়ও কমে গেছে ঘাটকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও হকারদের।

আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ফলে দৌলতদিয়ায় যানবাহনের চাপ আরও কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে ঘাটকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও হকারদের জীবনমানের ওপর প্রভাব পড়বে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। এজন্য দৌলতদিয়া ঘাট আধুনিকায়নের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও হকাররা।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। প্রতিদিন এ ঘাট ব্যবহার করে পদ্মা নদী পারাপার হয় কয়েক হাজার ছোট-বড় যানবাহন ও লক্ষাধিক যাত্রী। যে কারণে ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা। হকারি, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা করে প্রায় তিন থেকে চার হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) এক কর্মকর্তা জানান, দৌলতদিয়া ঘাটের গুরুত্ব এখন যেমন আছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলেও ঠিক তেমনি থাকবে। শুধু কিছু যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে। তবে সেটা সীমিত সময়ের জন্য। কারণ প্রথম প্রথম অনেক যানবাহন পদ্মা সেতু দিয়ে যাবে। পরবর্তীতে ঠিক তাদের অনেকে দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবহার করবেন। কারণ চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ ওই অঞ্চলের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য কিছু যানবাহন সেতু ব্যবহার করবে। কিন্তু যারা মানিকগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, গাবতলীসহ এ অঞ্চলে যাবেন, তাদের তো অবশ্যই দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবহার করে যেতে হবে। যে কারণে দৌলতদিয়া ঘাট ও পদ্মা সেতু উভয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আগের মতো ভোগান্তি থাকবে না দৌলতদিয়ায়।

দৌলতদিয়া ঘাটের হকার শিমুল, ইয়াকুব, ইমান শেখ, রফিকসহ অনেকে  বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দৌলতদিয়া বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ও ফেরি ঘাট এলাকায় ঝালমুড়ি, আইসক্রিম, পেঁয়াজু, পেয়ারা, শরবতসহ হরেক রকম মুখরোচক খাবার বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছি। কিন্তু কিছুদিন যানবাহনের চাপ কমে যাওয়ায় আমাদের বেচাবিক্রিও কমে গেছে। এরপর আবার চালু হচ্ছে পদ্মা সেতু। তখন তো যানবাহনের সংখ্যা আরও কমে যাবে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা হলে আমাদের সংসার চালানো দায় হয়ে পড়বে।’

রিকশাচালক শাজাহান সরদার বলেন, যানবাহন ও যাত্রীর সমাগম যত বেশি হয় তাদের আয়ও তত বেশি হয়। বর্তমানে ঘাটে যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন।

কথা বলতে গিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন হোটেল ব্যবসায়ী মো. লোকমান। তিনি বলেন, ‘ফেরির অপেক্ষায় থাকা যাত্রী ও যানবাহনের চালকরা হোটেল থেকে ভাত, রুটি, পরোটাসহ অন্যান্য জিনিস কিনে খেতেন। কিন্তু দিন দিন যাত্রী ও যানবাহনের সংখ্যা কমছে। এতে আমাদের ব্যবসাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সামনে কী হবে আল্লাহ জানে।’

আগে দিনে ৫-৭ হাজার টাকার বেচাকেনা করেছেন মুদিদোকানি আসলাম হোসেন আকাশ। এখন তা কমে ২-৩ হাজারে নেমেছে। তিনি বলেন, ‘এখন যে অবস্থা তাতে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে কিছুই থাকছে না।’

যানবাহনের চালক আনোয়ার বলেন, যাত্রীদের সুবিধা অনুযায়ী মালিকরা রুট ঠিক করবেন। যে রুটে যাত্রী বেশি হবে সেই রুটে তারা যাবেন।

চালক আনোয়ারের মতে, দৌলতদিয়া ও পদ্মা সেতু উভয় পাশ দিয়েই যানবাহন পারাপার হবে। কারণ সেতুর ওই পারে যাদের কাছে হবে তারা সেতু দিয়ে এবং দৌলতদিয়া দিয়ে যাদের গন্তব্য কাছে হবে তারা এ পাশ দিয়ে যাবেন। তবে সেতু দিয়ে একটু দ্রুত আসা-যাওয়া করা যাবে। বর্তমানে দৌলতদিয়ায় কোনো ভোগান্তি বা অপেক্ষা ছাড়াই তারা ফেরির নাগাল পাচ্ছেন বলে জানান এ চালক।

জেলা সড়ক পরিবহনের দৌলতদিয়া ঘাট শাখার সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন তপু বলেন, ‘দৌলতদিয়া ঘাটে পরিবহন সেক্টরের প্রতিনিধি এবং ঘাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীসহ ঘাট, বাস টার্মিনাল ও স্টেশন এলাকায় সবমিলিয়ে প্রায় চার হাজারের মতো শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তবে প্রায় দুই সপ্তাহ হলো ঘাটে যানজট ও ভোগান্তি নাই। ফলে হোটেল ও দোকানপাটে লোকজনও নেই। সবাই বেকার বসে আছেন। পদ্মা সেতু চালু হলেই এদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়বেন।’

তিনি আরও বলেন, দৌলতদিয়ায় নদীশাসনের পাশাপাশি আধুনিকায়ন বন্দর করা হবে বলে প্রায় দুই বছর ধরে শুনে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই হচ্ছে না। এ কাজ হলে শ্রমিকরা বিকল্প কর্ম করে বাঁচতে পারবেন।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির ডিজিএম শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দৌলতদিয়ায় কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। তবে সেটা বড় ধরনের হবে না।

তিনি বলেন, সেতু পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে গাবতলীতে আসা যাত্রীদের একটু সমস্যা হবে। কিন্তু দৌলতদিয়া দিয়ে সে যাত্রা সহজ হবে। তবে খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলের বাসের চাপ কমবে। তারপরও যানবাহনগুলো রুট ভাগাভাগি করে চলাচল করবে বলে মনে করছেন তিনি।

বর্তমানে ঘাট পারাপারে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় কোনো ভোগান্তি নেই বলে জানান বিআইডব্লিউটিসির এ কর্মকতা।

তিনি বলেন, যানবাহনগুলো অপেক্ষা ছাড়াই সরাসরি ফেরিতে উঠতে পারছে। অন্য সময় যানবাহনের চাপ যেমন থাকে এখনো ঠিক তেমনি আছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক ফেরি চলাচল করায় এটা সম্ভব হচ্ছে।

২০টি ফেরি দিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের উভয় প্রান্ত দিয়ে ছোট-বড় সাত হাজার ৭০০ যানবাহন পারাপার হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে সবমিলিয়ে প্রথম অবস্থায় ৩০ শতাংশ যানবাহনের চাপ কমতে পারে বলে ধারণা করছেন বিআইডব্লিউটিসির ডিজিএম শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ।