দুর্বল ও অপরিণত মাটির কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার পদ্মাপাড়ের মানুষ। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মা নদীতে আকস্মিক পানিবৃদ্ধি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ফলে সবসময় হুমকির মুখে থাকে ঘরবাড়ি আর ফসলি জমি। নিজেদের বসতভিটা হারিয়ে অনেকেই এখন অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিবছরই ভাঙনের শিকার হয় এ অঞ্চলের হাজারো পরিবার। ফলে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে টিনের ঘরে বসবাস করেন।
পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং বাকি ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার জাজিরা এলাকায়। নদীশাসন কাজ শুধু সেতু রক্ষা করেনি, পাশাপাশি হাজারো মানুষের বাপ-দাদার ভিটাও রক্ষা করেছে। একটা স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে।
স্থায়ী ব্যবস্থা হওয়ায় এখন ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় এ অঞ্চলের জনপদ নেই। এক সময় ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন পদ্মাপাড়ের মানুষ। এখন কেটেছে সেই কালো মেঘ।
পদ্মাপাড়ে কথা হয় জাজিরা কাজিরহাট বন্দরের আমিনুল মাতব্বরের সঙ্গে। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। পদ্মার ভাঙনে কতবার নিজের বসতভিটা এই জীবনে সরাতে হয়েছে তা আঙুলে গুণে গুণে হিসাব দিচ্ছেন বয়স্ক এই মানুষটি। খরস্রোতা পদ্মার ভাঙন যেন তার জীবনকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। পদ্মা সেতুর কল্যাণে নদীশাসন কাজ যেন তার জীবনে সব থেকে বড় কল্যাণ বয়ে এনেছে।
পূর্ব নাউডোবা ইউনিয়নে চা খেতে খেতে কথা হয় সেরু কাজীর সঙ্গে। তার কাছে সেতুর সব থেকে বড় কল্যাণকর নদীশাসন।
তিনি বলেন, আগে বন্যায় অনিশ্চয়তা থাকতো। এই বুঝি বাড়িঘর পদ্মা নিয়ে গেলো। কিন্তু বাঁধ দেওয়ার কারণে সেই ভয় এখন নেই। রাতে অন্তত শান্তিতে ঘুমাতে পারি।
জমির দাম আকাশচুম্বী: জাজিরার পূর্ব নাউডোবা ইউনিয়ন, পশ্চিম নাউডোবা ইউনিয়ন, পৌরসভা, বিকে নগর, কাজিরহাট বন্দর, রুপাপুর হাটে জমির দাম আকাশচুম্বী। বাঁধ দেওয়ার আগে এখানে এক কড়া (দুই শতক) জমি এক থেকে দেড় লাখ টাকা দরে বিক্রি হতো। এখন সেই জমির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ টাকা কড়া। জাজিরা সিটারচর ও কুঞ্জুর চরে এক কড়া জমির দাম ছিল ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা। কারণ এই জমি এই আছে এই নেই। চোখের পলকে পদ্মার গর্ভে চলে যায়। অথচ এখন এই জমির দাম বেড়ে হয়েছে কয়েক লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় জাজিরা পৌরসভার মেয়র মো. ইদ্রিস মাদবরের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার পৌরসভায় যে জমির দাম ছিল এক থেকে দেড় লাখ টাকা কড়া, তা এখন বেড়ে ১২ লাখ টাকা হয়েছে। কারণ বাঁধের কারণে জমির অনিশ্চয়তা কেটেছে। মানুষ তাই জমি কিনতে ব্যস্ত। অনেকে নানা ধরনের ফাস্টফুডের দোকান ও রেস্তোরাঁ দিচ্ছে। সর্বশেষ মানুষের আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয়, ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার সংযোগ।
পদ্মাপাড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাষিরাও অনেক লাভবান হবেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে অর্থনীতির চাকাও সচল হবে। সাধারণ মানুষ কৃষিপণ্য সুলভমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করবেন। পদ্মাপাড়ে নানা ধরনের শাক-সবজি হয়। এসব শাক-সবজি ঢাকায় নিতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগতো। অথচ এখন স্বল্প সময়ে ঢাকায় নেওয়া যাবে। ফলে সবাই উচ্ছ্বসিত সেতুর উদ্বোধনে।
মাদারীপুর শিবচরের সাহেব বাজারের মোহাম্মদ বাহাদুর মাল বলেন, আমার মোট দুটি দোকান আছে। এখন পান কিনি বরিশাল থেকে, সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে কিনতে পারবো। আগে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগতো এখন এক থেকে দেড় ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছাতে পারবো। মালপত্র নিয়ে একদিনে দু-তিনবারও ঢাকায় থেকে আসা যাওয়া করতে পারবো। আমার একটা দোকান আছে পার্টসের। সেতু চালু হলে দ্রুত সময়ে এটা-ওটা ঢাকা থেকে আনা যাবে।
পদ্মাপাড়ের উর্বর জমিতে নানা ধরনের ফসল হয়। জমিগুলো অনিশ্চয়তায় থাকতো ভাঙনের কারণে। তবে সেই অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দূর হয়েছে সেতু পাড়ে। চাষিদের নানা ধরনের ফসল ও সবজি দ্রুত ঢাকায়ও নেওয়া যাবে।
পদ্মাপাড়ে কথা হয় বিকে নগরের সবজি চাষি হাফিজুর ব্যাপারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের এখানকার পাট শাকের কদর ঢাকায় অনেক বেশি। এছাড়া পেঁয়াজ, করলা, শসা, ধন্দুল ও লাউ ভালো হয়। ঢাকায় বর্তমানে ফেরি পারাপারের কারণে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। ফেরিতে সময় বেশি লাগে ফেরি পারাপারে ঝামেলা হয়। তবে সেতু চালু হলে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় সবজি ঢাকার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারে বিক্রি করতে পারবো।
শুধু পদ্মার পাড় নয় শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়ও প্রভাব পড়েছে। নড়িয়ার পৌরসভার শুভগ্রাম, বাড়ইপাড়া, বিসমিল্লাহনগর, বৈশাখীপাড়া, ঢালিপাড়া ও বাঁশতলায় এক কড়া জমি ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নানা ধরনের ফাস্টফুডের দোকান তৈরি হয়েছে। ছোট ছোট বিপণি বিতানও তৈরি হয়েছে। কারণ বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যা।
নড়িয়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখন দুই শতাংশ জমির দাম ১৫ লাখ টাকা। আগে ছিল ২ লাখ। বাজারের জায়গার দাম আরও বেশি। মূলত পদ্মা সেতুর কারণেই আমাদের জমির দাম অনেক বেড়েছে। জমি কিনে অনেকে মার্কেট ও রেস্তোরাঁ দিচ্ছে।
নদীশাসন শুধু সেতু রক্ষা করছে না ভাঙন আতঙ্কও দূর করেছে: পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে নদীশাসন কাজের দৈর্ঘ্য ১৩ কিলোমিটার। এটির কাজও বহুমাত্রিক। নদীর তলদেশ খনন, ব্লক ও জিওব্যাগ ফেলা ও পাড় বাঁধাইয়ের কাজ করা হয়। এই কাজে ১ কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিটের ব্লক ও ২ কোটির বেশি বালুভর্তি জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। নদীখননের ফলে ২১২ কোটি ঘনফুট বালু স্থানান্তর করতে হয়। এই কাজ বাস্তবায়ন করছে চীনের আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। চুক্তিমূল্য ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। বর্তমান সময় পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কাজের ভৌত ও বাস্তব অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। এই কাজের ফলে পদ্মা সেতু পাড়ের মানুষের ভাঙন আতঙ্ক দূর হয়েছে।
বেড়েছে জমি বেচাকেনা, গড়ে উঠছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান: সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবায় শেখ হাসিনা তাঁতপল্লীর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। নদীশাসনের ইতিবাচক প্রভাব এখানে পড়ছে। কারণ নদীশাসনের কারণে ভাঙনের ঝুঁকিমুক্ত প্রকল্পটি। বর্তমানে তাঁতপল্লীর জন্য মাটি ভরাট ও সীমানা প্রাচীরের কাজ চলমান। চলতি বছরের জুনে শেষ হবে এই কাজ। শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে অন্তত ১০ লাখ মানুষের।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এক হাজার ৯১১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। পদ্মা সেতুর শরীয়তপুর প্রান্তের রেলস্টেশনের কাছাকাছি নির্মাণ হচ্ছে এ তাঁতপল্লী। যাতে এখানকার তাঁতিরা কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য সহজে আনা-নেওয়া করতে পারে। শরীয়তপুর জেলার জাজিরার নাওডোবা ইউনিয়নের নাওডোবা মৌজায় ৫৯ দশমিক ৭৩ একর ও মাদারীপুর জেলার শিবচরের কুতুবপুর মৌজায় ৬০ একর করে মোট ১১৯ দশমিক ৭৩ একর জমিতে এ তাঁতপল্লী হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড নির্মাণ হবে। যেখানে ৮ হাজার ৬৪ তাঁতিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। বার্ষিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৩১ কোটি মিটার কাপড়।
সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা গেছে, জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার মাসট্রেড নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি গার্মেন্টপল্লী, কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১০০ বিঘা জমি কিনেছেন। তার কেনা জমি জাজিরায় পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে।
পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের নাওডোবা মৌজায় ৩০ বিঘা জমি কিনেছে বাদশা টেক্সটাইল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দিকে প্রতি বিঘা জমির দাম ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ছিল। এখন একই এলাকায় জমির দাম বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। শুধু শিল্পে বিনিয়োগ নয়, অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল করার জন্যও জমি কিনছেন। জাজিরার বাসিন্দা আনোয়ার ফরাজি ঢাকার ফরাজি হাসপাতালের মালিক। তিনি জাজিরায় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কিনেছেন। সখীপুর হাজি শরীয়তউল্লাহ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল বাসার আল আজাদসহ কয়েকজন চাকরিজীবী মিলে জাজিরার লাউখোলা মৌজায় ১২ বিঘা জমি কিনেছেন। তাদের লক্ষ্য শিক্ষাপল্লী প্রতিষ্ঠা করা।
এছাড়া ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে শিল্পে বিনিয়োগের চেয়ে আবাসন প্রকল্প বেশি। জমিতে একের পর এক আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড দেখা গেছে। মূলত পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে গড়ে উঠছে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
এই প্রসঙ্গে শরীয়তপুর চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি ফারুক আহমেদ তালুদকার জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে সেতুর দুই পাড়ে জমির দাম আকাশচুম্বী। অনেকে জমি কিনে রেখেছেন নানা ধরনের শিল্প-কলকারখানা নির্মাণের জন্য। সামনে জমির দামও বাড়ছে। একেক জন একেক ধরনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে এসব জমি কিনেছেন। কেউ গার্মেন্ট, হিমাগার, হোটেল-মোটেল, আবাসিক হোটেল নির্মাণ করবেন। এখন দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। পদ্মাপাড়ে অর্থনৈতিক জোনও হবে। মূলত পদ্মা সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ একটা সংযোগ সড়ক নয়।