২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবার বাজেটের স্লোগান ‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’।
এ বাজেট তৈরিতে মহামারি পরবর্তী বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটকে সামনে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব কর নীতি, কর আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা দূরীকরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব নীতি গ্রহণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছানের লক্ষ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাত বাড়ানোর। বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপির অনুপাত ২৩ শতাংশ।
এদিকে করপোরেট কর হার কমিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর ছক কষছেন অর্থমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে এ বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন তিনি। এটা হবে দেশের ৫১তম বাজেট।
এবারের বাজেটের আকার যেমন বড়, তেমনি এর ঘাটতিও ধরা হচ্ছে বড়। অনুদান ছাড়া বাজেটের ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশের সমান। আর অনুদানসহ বাজেট ঘাটতির পরিমাণ হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৪০ শতাংশের সমান।
এ ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্য থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে। ফলে প্রকৃত বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে ঋণ নেওয়া হবে তার মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা নেওয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এর মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আর স্বল্প মেয়াদি ঋণ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। আর ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ ধরা হচ্ছে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা। যার মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং ৫ হাজার ১ কোটি টাকা অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মূলধন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। খাদ্য হিসাবে ৫৪০ কোটি টাকা এবং ঋণ ও অগ্রিম ব্যয় ৬ হাজার ৫০১ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে।
অপরদিকে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে, ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের জন্য ৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। এছাড়া বিভিন্ন স্কিম বাবদ ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির জন্য ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
এসব ব্যয়ের বিপরীতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব সংগ্রহের গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)।
রাজস্বের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে তার মধ্যে কর ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত আয় ধরা হচ্ছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
এবারের বাজেটে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে এক ব্যক্তি কোম্পানির কর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো এ ধরনের কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করা।
আর পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিও’র মাধ্যমে হস্তান্তর হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার সাড়ে ২২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ হচ্ছে। তবে আইপিও’র মাধ্যমে ১০ শতাংশের কম শেয়ার হস্তান্তর হলে কর হার সাড়ে ২২ শতাংশই থাকবে।
এছাড়া তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর হার আগের মতোই সাড়ে ৩৭ শতাংশ রাখা হচ্ছে। অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার হারেও আনা হচ্ছে না কোনো পরিবর্তন। আগের মতো এসব প্রতিষ্ঠানকে ৪০ শতাংশ কর দিতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হারও অপরিবর্তিত রেখে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করা হচ্ছে।
এদিকে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুলসহ সব প্রকার তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির কর হার ধরা হচ্ছে ৪৫ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ সারচার্জ। এ ক্ষেত্রেও কর হারে পরিবর্তন আসছে না। অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে মোবাইল ফোন কোম্পানির কর হার। চলমান অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের জন্য তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানির কর হার ৪০ শতাংশ এবং অ-তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানির কর হার ৪৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
তবে ব্যক্তি সংঘের কর হার ৩০ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে সাড়ে ২৭ শতাংশ। কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার কর হারও ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হচ্ছে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষায় নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের কর হার চলমান অর্থবছরের মতো ১৫ শতাংশই রাখা হচ্ছে।
ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত ও সহজ করতে ট্রেডিং পণ্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর হার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারি সরবরাহ ছাড়া বই সরবরাহের উৎসে কর হার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হচ্ছে ৩ শতাংশ। আর শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ম্যানুফ্যাকচারের নিকট কাঁচামাল সরবরাহের ওপর উৎসে কর হার ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া হলেও কর নেট সম্প্রসারণে হোটেল, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার এবং ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিকে উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে হাঁস-মুরগির খামার এবং সব হ্যাচারি ও মাছ চাষ থেকে আয়ের ওপর অভিন্ন কর হার আরোপ করা হবে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস মাথায় রাখতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে। এজন্য বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে তার ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে তার ওপর ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে রেমিটকৃত নগদ অর্থের উপর ৭ শতাংশ হারে কর ধার্য হচ্ছে। ফলে অর্থনীতির মূল স্রোতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে, বাড়বে রাজস্ব আহরণ এবং করদাতারা বিদেশে অর্জিত তাদের অর্থ-সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে স্বস্তিবোধ করবেন।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য এবারের বাজেটেও বিশেষ প্রণোদনা থাকছে। কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ২৫ জনের অধিক প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিলে ওই কর্মচারীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ বা প্রদেয় করের ৫ শতাংশ যেটি কম তা নিয়োগকারীকে কর রেয়াত হিসেবে দেওয়া হবে।
পণ্য ও সেবা রপ্তানি উৎসাহিত করার জন্য গার্মেন্টসের মতো অন্যান্য পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাতের কর হার ১২ শতাংশ হচ্ছে। আর ১০ শতাংশ করা হচ্ছে গ্রিন শিল্পের কর হার। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ দিয়ে বহির্বিশ্বে সেবা প্রদানের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা আয়কে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতকে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে বহুমাত্রিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে স্টার্টআপ উদ্যোগকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হবে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাদে অন্যান্য সব প্রকার রিপোর্টিংয়ের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে স্টার্টআপ কোম্পানির লোকসান ৯ বছর পর্যন্ত সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হবে। এছাড়া স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যয় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও টার্নওভার কর হার দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ১০ শতাংশ করা হচ্ছে।
ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ এবং মূল্য সাশ্রয়ীর লক্ষ্যে গ্যালভানাইজড আয়রণ শিট বা স্টিলজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত এইচআর কয়েল এবং জিংক জাতীয় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে করহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। আর স্বর্ণ আমদানিতে বিলোপ করা হচ্ছে বিদ্যমান অগ্রিম কর। এর উদ্দেশ্য দেশে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানিতে উৎসাহ এবং স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করা।