পত্রিকায় দেখলাম চট্টগ্রামে দুই আপন খালাতো বোনের মুখ এসিডে ঝলসে দেওয়ার ঘটনায় সাকি নামের এক মেয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। একই দণ্ড হলো এই ঘটনায় সাকির সহযোগী এক সহোদরেরও। কারণ হিসেবে জানা গেল, ‘বিয়ে নিয়ে ঈর্ষা।’

বছর দুয়েকের ছোট খালাতো বোনের বিবাহের প্রস্তাব এলেও সাকির নিজের জন্য কেন তেমন প্রস্তাব আসছে না তা নিয়েই ঈর্ষা। গণমাধ্যমে এভাবেই আমরা ঘটনাটা জানি। এর পেছনে কোনো তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন ছিল কি না তা জানা যায়নি।

ঘটনা প্রায় এক যুগ আগের। ঘটনার সময় সাকি ছিল বাইশ বছরের তরুণী। আর, বীভৎস এসিড সন্ত্রাসের শিকার খালাতো বোন ছিল তার বছর দুয়েকের ছোট। হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি মানব জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।

কোনো না কোনো পর্যায়ে কমবেশি সবার মধ্যেই এই বিষয়গুলো কাজ করে। কিন্তু, তাই বলে আপন খালাতো বোনের মুখ এসিড ঝলসে দেওয়ার মতো ঈর্ষাপরায়ণতা খুব বেশি দেখা যায় না। সমাজ সংসার নিয়ে যারা ভাবেন তাদের মনে এই ঘটনা নাড়া দেবে নিঃসন্দেহে।

প্রশ্ন জাগে, ঠিক কী কারণে সাকি নামের একটা তরুণী এতো অল্প বয়সে এমন ভয়ংকর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠল? কী এমন পরিবেশে মেয়েটি বেড়ে উঠেছিল যা তাকে এমন নির্দয় নিষ্ঠুর মানবে রূপান্তর হতে সহায়তা দিয়েছিল? মেয়েটির বাবা-মায়ের প্যারেন্টিং-এর কোথাও কি কোনো ঘাটতি ছিল যা তাকে আজ এই পরিণতি দিয়েছে? অপ্রত্যাশিত এই ঘটনা থেকে অন্য অভিভাবকদের শিক্ষণীয় কিছু আছে কি না তাও আমাদের ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র অর্থনীতির সমস্যা-সংকুল একটা ছোট্ট দেশে প্রতিষ্ঠা পেতে মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নানা স্তরের মানুষের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা চলমান।

অসম প্রতিযোগিতার অংশীদার কেবল বড়রা নয়, শিশুরাও। জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেতে নানামুখী প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। বৈবাহিক সম্পর্কও এর ব্যতিক্রম নয়।

সমাজের রূঢ় বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা বড়রাই শিশুদের মনে খুব ছোটবেলা থেকে প্রতিযোগিতার বীজ বপন করে দেই। অন্যথায়, তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে, সেখানেই যত ভয়, উৎকণ্ঠা আমাদের।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, ঠিক কতখানি প্রতিযোগিতার চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিলে একটা শিশু তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে চরম প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভেবে তাকে শারীরিক আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বসবে না? কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিয়ে এই বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

ধরুন, আপনার সন্তান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়নি, কিন্তু, আপনার ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত কারো সন্তান গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনি কি আপনার সন্তানকে এমন কথা বলতে পারেন, ‘তোমাকে তো সুযোগ সুবিধা কম দেইনি, তারপরও মতি (ছদ্মনাম) জিপিএ-৫ পেলে তুমি পেলে না কেন? তোমার খারাপ ফলাফলের কারণে আমরা তো এখন কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। …’

অনেক পিতামাতা আরও আগ বাড়িয়ে সন্তানকে এমন কারণে মারধর পর্যন্ত করেন বা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। একবারও ভাবেন না এমন মানসিক নিপীড়নের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি কি ফলাফল হতে পারে? এই ধরনের ঘটনায় অনেক সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়, এই ধরনের খবর আমরা পত্রপত্রিকায় পড়েছি।

পরিচিত কোনো মেয়ের বিবাহ ঠিক হয়েছে শুনে অনেক সময় নিজের কন্যাকে নিয়ে কটাক্ষ করে সরাসরি বা আকারে-ইঙ্গিতে আমরা বেফাঁস মন্তব্য করে বসি। যেন বলতে চাই, ‘তোমার বয়সী বা তোমার চেয়ে ছোট মেয়ের জন্য এত ভালো প্রস্তাব এলে তোমার জন্য কেউ প্রস্তাব দিচ্ছে না কেন? তুমি কেন ওর মতো হতে পার না?’ অর্থাৎ, উপযুক্ত পাত্র আসা না আসা যেন একান্তই মেয়ের দোষগুণের ব্যাপার।

এটা অবশ্যই মানসিক নিপীড়ন। এই ধরনের মানসিক চাপ প্রয়োগ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে এক সময় ভুক্তভোগী হতাশাগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে রূপান্তরিত হতে পার। ফলে, সে তার সমবয়সী অন্য মেয়েদের তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে চূড়ান্ত ক্ষেত্রে তার বা তাদের ক্ষয়ক্ষতি করারও চিন্তা করতে পারে।

এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিহিংসামূলক চিন্তা-চেতনা জাগ্রত হয়ে তার স্বাভাবিক বিবেচনা বা বুদ্ধি লোপ পেতে পারে। সাকি নামের মেয়েটি এমনই পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার কি না তাও ভেবে দেখার বিষয়।

নিজের অজান্তেই অনেক সময় অভিভাবকেরা সন্তানকে মানসিক নিপীড়ন করে থাকেন। প্রায়শই এসবে থাকে অসম প্রতিযোগিতা ও সামাজিক চাপ। অভিভাবকদের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতার বলি হয় তাদের নির্দোষ সন্তান। এমনই সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা পাঠকদের জানাচ্ছি।

কানাডার অভিবাসন পরামর্শক (আরসিআইসি) হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় স্টাডি পারমিট নিয়ে পড়তে আসা বিশ বছর বয়সী এক ছাত্র কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয় হতে যোগাযোগ করল আমার সাথে।

সমস্যা, যে পড়াশোনার প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে এসেছে তা ঠিকমতো হ্যান্ডেল করতে পারছে না সে। তাই, স্টাডি প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো সহজ প্রোগ্রামে স্থানান্তরিত হতে চায়।

এই অবস্থায় ইমিগ্রেশন সহযোগিতা চায় সে। এই ছাত্রের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে জানতে চাইলাম তারা তাদের সন্তানকে কানাডার এই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিশেষ প্রোগ্রামের পড়তে পাঠানোর চিন্তা কীভাবে করলেন?

জানা গেল, ছেলেটি জিপিএ-৫ পেয়েছে এবং এই একই ধরনের ফলাফল করে তাদের এক প্রতিবেশীর ছেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রামে পড়তে গেছে। তাই, তারাও এই প্রোগ্রামে তাদের সন্তানকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু, সন্তান যে এই প্রোগ্রাম ঠিকমতো হ্যান্ডেল করতে পারবে না তা তারা বুঝতে পারেননি।

উপরের ঘটনা পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না, স্টাডি প্রোগ্রাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছাত্রের পছন্দ বা মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিবেশীর সন্তান কী পড়তে গেছে তা-ই এই দম্পতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাঠকই বলুন, স্টাডি প্রোগ্রাম কি এভাবে নির্বাচন করা উচিত? আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, এই প্রতিবেশীর সন্তান আসলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেনি, সে এসেছে অন্য এক জায়গায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিং-এ কিছুটা এগিয়ে আছে বলে তারা সামাজিক ‘মর্যাদা’ বাড়াতে সঠিক তথ্য পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করেননি।

সঙ্গতকারণেই, উচ্চতর র‍্যাঙ্কিংয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে অধিকসংখ্যক মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্রছাত্রীর সমাহার। সেই পরিবেশে সাধারণ মানের কোনো ছাত্র সহজে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এক্ষেত্রেও পিতামাতার অসম প্রতিযোগিতার বলি হতে হচ্ছে আমার সাথে যোগাযোগ করা ছেলেটি।

ছাত্রকে অবশেষে একটা মাঝারি মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার পছন্দসই একটি প্রোগ্রামে স্থানান্তর করে স্টুডেন্ট ভিসা হালনাগাদ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এই কাজটি করা না গেলে তাকে হয়তোবা পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখেই কানাডা ছাড়তে হতো বা কানাডায় অবৈধভাবে বসবাস করতে হতো।

নিজের পরিবারের একটি ক্ষুদ্র ঘটনা দিয়ে এই লেখা শেষ করি। কানাডায় আমাদের কন্যা অয়ন যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তখন প্যারেন্ট-টিচার মিটিংয়ের সময় আমি তার শ্রেণিশিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম অয়ন তার ক্লাসের অন্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় পড়াশোনায় কেমন করছে?

যারা জানেন না, কানাডার স্কুল-কলেজে বাংলাদেশের মতো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি স্থান দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চিহ্নিত করা হয় না। সত্যি বলতে কি, এদেশে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলক কোনো পরীক্ষাও নেই।

এক শ্রেণির পড়া শেষ হলে তারা এমনিতেই বছর শেষে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে যায়। অর্থাৎ, শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা দূরের কথা, বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত নেওয়া হয় না। সহজ ভাষায়, শিশুদের কোনোপ্রকার মানসিক চাপে ফেলতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নারাজ।

যাই হোক, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমি কন্যার শিক্ষকের কাছে যে তার প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি র‍্যাঙ্কিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইছিলাম তা শিক্ষক ঠিকই ধরতে পেরেছেন।

আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আমাকে বললেন, ‘দেখুন মিস্টার গনি, আপনারা যে দেশ থেকে এসেছেন সেখানে বাচ্চাদের স্কুলে র‍্যাঙ্কিং পদ্ধতি আছে, ফলে সেখানে শিশুদের মধ্যে পড়াশোনায় তীব্র প্রতিযোগিতাও থাকে; কিন্তু, কানাডায় সেই বিষয় আপনি দেখবেন না। কেবল আমাদের বিদ্যালয় বলে নয়, অন্যসব স্কুলেও এই ধরনের র‍্যাঙ্কিং সিস্টেম নেই। আমরা এক শিক্ষার্থীর সাথে অন্যের তুলনা সেভাবে করি না। তবে, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনার কন্যার কাছ থেকে তার সেরাটি বের করে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে আমাদের।’

ইতিমধ্যে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সেই আমলে ওই শিক্ষকের কথাগুলোর মর্মার্থ যথাযথ উপলব্ধি করতে না পেরে ধরে নিয়েছিলাম কানাডার পড়ালেখা সম্ভবত বাংলাদেশের মতো ততটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ বা মানসম্মত নয়।

অথচ, আজ যখন দেখলাম লেখাপড়ায় তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করে আমাদের সেই অয়ন কানাডায় ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তখন স্বীকার না করে উপায় নেই যে, কানাডার এই আপাত প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশের অসম প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশের চেয়ে বহুগুণে বেশি উন্নত ও কার্যকর।

সবশেষে একটি কথাই বলব, সামাজিক চাপের প্রতিযোগিতায় জিততে আপনার সন্তানকে বিভিন্নক্ষেত্রে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের সন্তানদের সাথে তুলনা করে তাকে অহেতুক মানসিক চাপে রাখবেন না। রাখলে, তাতে তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং ফলে, সে ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে পরিণত হতে পারে, যার অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হতে পারে আপনজনদের সাথেও চূড়ান্ত পর্যায়ের ঈর্ষাকাতরতা।

প্রতিহিংসা বা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এসিড সন্ত্রাসের মতো সহিংস ঘটনা যেন আর শুনতে না হয় সেই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যেতেই হবে।