মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের সাবেক আমির রেজাউল করিম মন্টুসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রেজাউল করিম মন্টু ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামিরা হলেন- মো. শহিদ মণ্ডল ও মো. নজরুল ইসলাম (পলাতক)
মামলায় প্রথমে চারজনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে মো. ইসহাক তদন্ত চলার সময়ই গ্রেফতার অবস্থায় মারা যান।
মঙ্গলবার (৩১ মে) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম।
এর আগে এ বিষয়ে শুনানি শেষে গত ২৬ এপ্রিল মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। এরপর গত ২৯ মে মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য ৩১ মে দিন ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল। তারই ধারাবাহিকতায় এই রায় ঘোষণা করেন আদালত।
আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, আবুল কালাম আযাদ ও তাপস কুমার বল। আর আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান ও গাজী এম এইচ তামিম।
সৈয়দ হায়দার আলী জানান, আজকের মামলাটি হলো ট্রাইব্যুনালের ৪৬তম রায়। রায়ে ১৪৪ পৃষ্ঠা ও ৩৩৩ প্যারার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়েছেন বিচারক।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী সন্তুষ্ট প্রকাশ করে সাংবাদিদের বলেন, আসামিদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিরা যদি রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করেন, সেখানেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকবে বলে আমরা আশা করি। রায়ে প্রসিকিউশন সন্তুষ্ট।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, যথাযথ বিচার হয়নি। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করলে তারা খালাস পাবেন।
প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলাটি গত ২৬ এপ্রিল সিএভি রাখেন ট্রাইব্যুনাল। মামলায় তিনজন আসামি। তার মধ্যে দুজন গ্রেফতার ও একজন পলাতক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগে বিচার হয়েছে।
২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর মামলাটির তদন্ত শুরু হয়। এক বছর ধরে চলা তদন্তে মোট ৩১ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ১২ ফেব্রুয়ারি আসামি শহিদ মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়।
আসামি রেজাউল করিম মন্টু জয়পুর হাট সদরের বাসিন্দা। জেলা শহরের প্রফেসর পাড়ার রাজাকার বিল্ডিং নামে পরিচিত বাসায় থাকতেন। আর পলাতক নজরুল ইসলাম ঢাকায় তেজগাঁওয়ে থাকতেন। শহিদ মণ্ডলের বাড়ি নওগাঁর বদলগাছি থানার চাঁপাডাল গ্রামে।
তদন্ত প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রসিকিউশন ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর মামলাটি আদালতে দাখিল করেন। শুনানি নিয়ে আদালত ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এরপর ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর যক্তিতর্ক শুরু হয়ে ২৬ এপ্রিল শেষ হয়। ওইদিনই মামলাটি রায়ের জন্য রাখা হয়।
সাতজনকে হত্যাসহ অবৈধভাবে আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে সম্পদ ধ্বংসের অপরাধে আসামিদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ গঠন করা হয়।
তদন্ত সংস্থা জানায়, আসামি মো. রেজাউল করিম মন্টু ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী জয়পুরহাট জেলার আমির ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ওই সময় থেকেই তিনি জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজ বাড়িতে চলে আসেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি আত্মগোপন করেন। বাকীরাও জামায়াতের সমর্থক বলে জানানো হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আসামিরা নওগাঁর (সাবেক রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমা) বদলগাছী থানায় অপরাধ সংঘটন করেন
এ মামলায় মোট তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো:
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর বিকেল আনুমানিক ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সময়ে আসামিরা নওগাঁর বদলগাছি থানার পাহাড়পুর ইউনিয়নের রানাহার গ্রামে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র সাহেব আলী, আকাম উদ্দিন, আজিম উদ্দিন মণ্ডল, মোজাফফর হোসেনকে হত্যাসহ ওই সময় ১০-১২টি বাড়ি লুট করে অগ্নিসংযোগ করে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর দুপুর আনুমানিক দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সময়ে আসামিরা নওগাঁর বদলগাছী থানার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খোজাগাড়ী গ্রামে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র মো. নুরুল ইসলামকে হত্যা করে। এসময় তারা ১৫-২০টি বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ করে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর বিকেল আনুমানিক ৫টা থেকে পরদিন অর্থাৎ ৯ অক্টোবর আনুমানিক বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময়ে নওগাঁর বদলগাছী থানার পাহাড়পুর ইউনিয়নের মালঞ্চা গ্রামে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের মো. কেনার উদ্দিন এবং মো. আক্কাস আলীকে অবৈধভাবে আটক করে নির্যাতন করে। পরে অপহরণ করে জয়পুরহাটের কুঠিবাড়ি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এই সময়ের মধ্যে আসামিরা ৪০-৫০টি বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ করে।