ধূমপান দিয়ে শুরু করে পরে নেশায় জড়িয়েছেন মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই। একজন ধূমপায়ীর সাধারণত একাধিক ধূমপায়ী বন্ধু থাকে। এদের মধ্যে কেউ মাদকাসক্ত হলে অন্যদের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। এভাবেই একজনের প্রভাবে অন্য বন্ধুরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। একবার যখন কেউ কোনো মাদক গ্রহণ করেন, তখন তিনি একের পর এক অন্য মাদক গ্রহণেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে মাদক গ্রহণ লুকিয়ে হলেও ধূমপান হয় অনেকটা প্রকাশ্যেই। দেশের সব বড় বড় শহর, বাজার, স্কুল-কলেজের আশপাশের মতো ব্যস্ত এলাকায় বা জনসম্মুখেই অবাধে চলছে ধূমপান।

প্রকাশ্যে ধূমপান করলে দেশে রয়েছে জরিমানার আইন। তবুও তাতে যেন কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনকি ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ও ক্যান্সারের কারণ, এটি জানা সত্ত্বেও হরহামেশায় পাবলিক প্লেসে ধূমপান করছেন অসংখ্য মানুষ। মূলত আইনের প্রয়োগ না থাকায় ধূমপায়ীদের মধ্য থেকে এ প্রবণতা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ধূমপানের এই ভয়াবহ প্রভাব যে শুধু ধুমপায়ীর ক্ষতি করে, তা নয়। পরোক্ষভাবে তা পাশের জনেরও ক্ষতি করে। পরোক্ষ ধূমপানের সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। গণপরিবহন, পার্ক, সরকারি-বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, রেস্তোরাঁ, শপিং মল, পাবলিক টয়লেটসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে হরহামেশায় বিভিন্ন বয়সীদের ধূমপান করতে দেখা যায়। অথচ, জনসমাগমস্থলে ধূমপান বন্ধে ২০০৫ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।

ধূমপান বন্ধে ২০০৫ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিল ৫০ টাকা। পরে ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনী এনে জনসমাগমস্থলে ধূমপানের শাস্তির অর্থ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ও আইন না জানায় প্রকাশ্যে ও জনসমাগমস্থলে ধূমপান বন্ধ হয়নি।

সূত্র জানিয়েছে, সরকারের প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো ২০৪০ সাল নাগাদ দেশে তামাকসেবীর হার পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। এটি করতে হলে তামাক উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও তামাকসেবীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মূলত বাজারজাতকরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই তামাকপণ্য বিক্রিতে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপের কথা ভাবছে সরকার।

কেউ বলছেন, তামাক কোম্পানিগুলোর স্বার্থেই একটি মহল সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত করছে।

প্রকাশ্যে ধূমপানের জন্য জরিমানার আইন থাকা সত্ত্বেও যত্রতত্র ধূমপান করতে দেখা যায় অনেককেই। পাবলিক প্লেসে ধূমপান যে আইনত অপরাধ তা স্বীকারও করেন অনেকে। তবে তাদের অনেকের প্রশ্ন- জরিমানাটা নেবে কে? কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশের অনেক সদস্য পাবলিক প্লেসে হরহামেশা ধূমপান করছেন। শুধু পুলিশ নয়, স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখা যায়।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধে আইন প্রণয়ন করার পর শুরুর দিকে তা বাস্তয়ায়ন করতে পুলিশ কিছু অভিযানও চালিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর আইন অমান্য করে খোদ পুলিশের অনেক সদস্যই প্রকাশ্যে ধূমপান করেন। আর এর সুযোগ নেয় জনগণও। এভাবে পুলিশ-জনতার দায়িত্বহীনতায় কেতাবি বিষয়ে পরিণত হয় ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন।

মূলত ধূমপান আইন মেনে না চলার প্রবণতা, জরিমানার পরিমাণ কম হওয়া এবং তামাক উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাপটের কারণে আইন প্রয়োগে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।

ধূমপায়ীদের কারণে অধূমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে নারীরা কর্মস্থলে ও নারী-শিশুরা পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া সম্প্রতি নারীদের মধ্যেও ধূমপানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে মা ও অনাগত সন্তান মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটার হার বেশি। এছাড়া গর্ভস্থ ভ্রুণেরও অনেক ক্ষতি করে। যেমন- জন্মের সময় নবজাতকের ওজন আদর্শ ওজনের তুলনায় কম হওয়া ও সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম (কোনো কারণ ছাড়াই এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ঘুমের মধ্যে আচমকা মৃত্যু) হার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিগারেটে প্রায় পঞ্চাশটির মতো রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে- যা মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। তামাকে নিকোটিন নামে আরেকটি উপাদান আছে যা আসক্তি সৃষ্টির জন্য দায়ী। অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৫ শতাংশই ছিল তামাক সেবনজনিত কারণ। যা সংখ্যায় প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার জন। এছাড়াও প্রায় ১৫ লাখ (দেড় মিলিয়ন) প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। এমনকি প্রায় ৬১ হাজার শিশুর অসুস্থতার কারণ ছিল তামাকের ব্যবহার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই। তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ, যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার সুযোগ থাকায় পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় আইনটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ধূমপান বন্ধে যে আইনটি রয়েছে তা সংশোধন এবং বাস্তবসম্মত করা প্রয়োজন। কারণ রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গায় প্রতিনিয়ত পাবলিক প্লেসে ধূমপান চলছে হরহামেশায়। ধূমপান বন্ধ করা বা আইন প্রয়োগের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি হিসেবে জরিমানার পর তা মিডিয়াতে প্রচার-প্রচারণা চালালে তা দেখে অনেকেই সতর্ক হবেন।

ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা প্রয়োজন
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে এক প্রতিক্রিয়ায় তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তামাকের কারণে আমাদের আবাদযোগ্য জমি, বনভূমি, মৎস্যক্ষেত্র প্রভৃতি সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে এই তামাক। সরকারের উচিৎ হবে শক্তিশালী আইন ও কর পদক্ষেপের মাধ্যমে তামাকের আগ্রাসন বন্ধ করা।

তিনি বলেন, তামাকের বহুমুখী ক্ষতির প্রভাব থেকে সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করতে হবে। এছাড়া সব পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, সুনির্দিষ্ট আবগারি শুল্ক আরোপের মাধ্যমে সিগারেটসহ সব তামাক পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে হবে।

জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালের অনারারি সিনিয়র কনসালটেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ২০০৫ সালে প্রণিত আইন সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে আমরা প্রস্তাব জানিয়েছি। আইন প্রয়োগে একটি টাস্কফোর্স রয়েছে যাদের কাজ হলো একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে যাবেন এবং সেখানে যদি কেউ ধূমপান করেন তাহলে তাকে জরিমানা করবেন। কিন্তু তা আমরা দৃশ্যমান দেখছি না। আজ তামাকমুক্ত দিবস- আজ জরিমানা করবো তা নয়। বছরের প্রতিটিদিন ঘুরে ঘুরে টাস্কফোর্সকে নজরদারি করতে হবে।

তিনি বলেন, জরিমানার বিষয়টি আরও বেশি দৃশ্যমান করতে হবে এবং মিডিয়াতে আসতে হবে। যাতে পরবর্তীতে কেউ পাবলিক প্লেসে ধূমপান করতে গেলে জরিমানার বিষয়টি চিন্তা করেন। তবেই আরও বেশি মানুষ সচেতন হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তির বিধান জরিমানা আছে। তার প্রয়োগ হলে পাবলিক প্লেসে হয়তো ধূমপান বন্ধ হয়ে যাবে। তবে পরিবেশ রক্ষার জন্য হলেও তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তামাক ও সিগারেট ব্যবহারে পরিবেশ নষ্ট হয়। সিগারেটের ফিল্টার মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।

তিনি বলেন, যাদের সন্তান হচ্ছে না তাদের ধূমপান বন্ধ করতে হবে। ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ মানুষের জীবন বাঁচাতে হলে তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অনেকে দেখা যায় মুখে গুল রাখেন। গুলের ব্যবহারে মুখে ক্যনসার হয়। তামাকের ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, করোনারি হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক হয়। এছাড়া ধূমপান ডায়াবেটিসেরও কারণ।