গত মাসের শেষ দিকে খবর ছড়ায়, পাম তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বের শীর্ষ পাম তেল রপ্তানিকারক দেশটির ঘোষণা কার্যকর হওয়ার আগেই প্রভাব পড়ে দেশের বাজারে। ফলে আগে থেকেই অস্থিতিশীল তেলের বাজার তেতে ওঠে আরও। ২৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়া যখন নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের ঘোষণা দেয়, তখন তেলশূন্য হয়ে পড়ে দেশের খোলাবাজার। মুহূর্তে বাজার থেকে উধাও হতে থাকে সয়াবিন তেল। রাতারাতি দাম বেড়ে যায় সরিষার তেলেরও। কিন্তু এর তিন সপ্তাহ পর ইন্দোনেশিয়ায় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে সে খবর যেন কানেই পৌঁছেনি ব্যবসায়ীদের!
এর আগে সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকার এক লাফে সয়াবিনের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ায়। বাড়ে পাম তেলের দামও। দাম বাড়ার ঠিক পরপরই দোকানে দোকানে ফের তেল পাওয়া যেতে শুরু করে। পূর্ণ হয়ে ওঠে তেলের শূন্য ড্রামগুলো। বিভিন্ন জেলায় গুদাম থেকে উদ্ধার হতে থাকে হাজার হাজার লিটার তেল।
কিন্তু বিশ্ব বাজারে দাম কমার পর গল্পটা উল্টো। এক সপ্তাহ আগে খবর এসেছে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। সেটি গত সোমবার (২৩ মে) থেকে কার্যকরও হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী পাম তেল সরবরাহ স্বাভাবিক হচ্ছে। দামও কমছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এরই মধ্যে তেলের দাম কমিয়ে ফেলেছে।
অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চলছে অস্থিরতা
অন্যদিকে দেশে সয়াবিন তেলের সিংহভাগ আসে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে। এ দুই দেশেই এপ্রিলের শেষ দিকের তুলনায় মে মাসে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ।
পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে মুখে যেন কুলুপ এঁটেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। যেন তারা এসব খবর পান-ই না। এ বিষয়ে কোনো আলাপই নেই। দেশের বাজারে তেলের দাম কমার কোনো লক্ষণও নেই। উল্টো ভোজ্যতেলের আমদানিকারকরা এখন শোনাচ্ছেন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির নতুন গল্প।
ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার খবর এলেই দেশের বাজারে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু নিম্নমুখী হলে সেটা যথাসময়ে কার্যকর হয় না কখনো। দাম কমার খবর এলেই গড়িমসি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। যতটা কালক্ষেপণ করতে পারেন, তাদের মুনাফা ততই বাড়ে। ফলে বিশ্ববাজারে দর কমা ও বাড়া, উভয় ক্ষেত্রেই প্রতারিত হন সাধারণ মানুষ। মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের শতভাগেরও বেশি মাশুল গুনতে হলেও কমার সুফল তারা পান খুব কম।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের কোনো নীতি নৈতিকতা নেই। তারা যে কোনো অজুহাত পেলে সেটাকে ইস্যু বানিয়ে ভোক্তার পকেট কাটেন।
তিনি বলেন, সরকার ব্যবসার প্রসার চায়। কিন্তু সে সুযোগ নিয়ে তারা ভোক্তাকে জিম্মি করছে। ব্যবসার প্রসার ভোক্তার পকেট কাটার লাইসেন্স হতে পারে না। তাদের নৈতিক করার জন্য অবশ্যই সরকারের কঠিন মনিটরিং করতে হবে।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু তেলের ক্ষেত্রে এমন হচ্ছে তা নয়। বর্তমানে বাজারে আমদানি সংকটের অজুহাতে আটা-ময়দা ও পেঁয়াজের দামও অস্থিতিশীল রয়েছে।
চলতি মাসের শুরুতে যে অজুহাতে আটা, ময়দা ও গমের দাম বেড়েছিল, সেটি কার্যকর হয়নি। তবে বাড়তি দাম ঠিকই কার্যকর রয়েছে। ভারত গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিতে না দিতেই পাইকারি বাজারে গমের দাম ২৫ শতাংশের মতো বেড়েছিল। নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও সে দাম আর কমেনি। ১৪ মে ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করলেও বাংলাদেশের জন্য সে শর্ত শিথিল রয়েছে।
দাম বাড়ার পর উদ্ধার হতে থাকে লাখ লাখ লিটার তেল
তারপরও দেশে বেড়েছে গম, তা থেকে তৈরি আটা ও ময়দার দাম। ফলে আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি বিস্কুট, ব্রেড ও প্রায় সব বেকারি পণ্যের দাম বেড়েছে। এমনকি রেস্তোরাঁয় পরোটার দামও বেড়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসেই আটার দাম বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ আর ময়দার ১৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।
একইভাবে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির আইপিও বন্ধের কারণে দেশে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। যা দেশি পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরেও স্বাভাবিক হয়নি।
এসব বিষয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, পুরোনো ওইসব সংকট কাটলেও বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির করণে কম দামে পণ্য কেনা যাচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার প্রভাব দেশের বাজারে নেই কেন, এমন প্রশ্ন করা হলে শীর্ষ আমদানিকারক বা তাদের প্রতিনিধিদের কেউই কথা বলতে চাননি।
সার্বিক বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, তেলের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞার সময় দাম নির্ধারণ করেছিল। এখন নিষেধাজ্ঞা কেটে গেছে। নতুন করে আমদানি করা তেলের মূল্য বিবেচনায় আগামীতে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।