সড়কে মৃত্যু যেন এখন বিভীষিকা। কোনোভাবেই থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা। কেবল ২০২১ সালেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রায় আট হাজার মানুষ। চলতি বছরও অব্যাহত রয়েছে সেই ধারা। ২০২২ সালের এপ্রিলেই সড়কে ঝরেছে ৫৪৩ প্রাণ। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি পঙ্গুত্বও বরণ করছে অসংখ্য মানুষ। কাটা পড়ছে হাত-পা। পাশাপাশি অন্য দুর্ঘটনায়ও হাত-পা হারাচ্ছে বড় একটি অংশ। দুর্ঘটনায় ক্ষতির শিকার এসব মানুষ একপর্যায়ে বেঁচে থাকে কৃত্রিম হাত-পা নিয়ে। তাতেও রয়েছে ভোগান্তি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এখন কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে পুরোপুরি আগের অবস্থায় না ফিরলেও জীবন চালিয়ে নিতে পারেন অনেকে। দেশে সরকারিভাবে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি ও সংযোজনের কাজটি হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর)। যেটি পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত। হাসপাতালে রয়েছে একটি লিম্ব সেন্টার (কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্র)। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সরকারি এ লিম্ব সেন্টারটি বন্ধ। এতে হাত-পা হারানো মানুষেরা পোহাচ্ছেন ভোগান্তি। নিরূপায় হয়ে বেশি অর্থ ব্যয়ে বাইরে থেকে কৃত্রিম অঙ্গ কিনে সংযোজন করতে হচ্ছে। অর্থ সংকটে কিনতেও পারছেন না অনেকে। আবার বাইরের এসব কৃত্রিম অঙ্গের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে না পাওয়া গেলেও সব ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ মিলছে বাইরে ফুটপাতের বিভিন্ন দোকানে। প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের লিম্ব সেন্টারটি বন্ধ থাকায় ফুটপাত থেকে উচ্চমূল্যে সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। এসব সরঞ্জামের মান নির্ণয় করারও কোনো ধরনের পদ্ধতি নেই। যে যেভাবে পারছেন এগুলো বিক্রি করছেন। যারা তৈরি করছেন তাদের অধিকাংশেরই অনুমতি নেই। তবে এ বিষয়ে নানা অজুহাতে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও লিম্ব সেন্টার দ্রুত চালু করা হবে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

ময়মনসিংহ সদরের বাসিন্দা মোতালেব হোসেন। সড়ক দুর্ঘটনায় বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে। শরীরে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারিয়েও থেমে থাকেননি মোতালেব। এখন তিনি কাটা পা নিয়ে রিকশা চালান। কিছুটা স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ফুটপাত থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কৃত্রিম পা কিনেছেন। কিন্তু কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের মাধ্যমে তার পায়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে ক্ষত। অনেক সময় পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অসহ্য ব্যথা হয় বলে দাবি তার।

মোতালেব বলেন, পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছি। এক সময় এখানে কৃত্রিম পা বিনামূল্যে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন নেই। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কৃত্রিম পা লাগিয়েছি। এতে শরীরে অসহ্য ব্যথা করে। কাপড় ও তুলার সাহায্যে কোনো রকমে কৃত্রিম পা ব্যবহার করতে পারছি।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সরকারি লিম্ব সেন্টারটি বন্ধের সুবাদে হাসপাতালের আশপাশের দোকানগুলোতে কৃত্রিম অঙ্গ বেচাকেনা জমজমাট। এসব কৃত্রিম অঙ্গের সিংহভাগ তৈরি হচ্ছে নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে। সরকারের অনুমোদনহীন এসব কারখানায় তৈরি হয় কৃত্রিম পা, সার্জিক্যাল জুতা, হাত ছাড়াও সার্জিক্যাল কলার, ওয়াকার, ট্রেইলার ব্রেইচ, পেলভিক ট্রাকসন, ক্র্যাচ, চেস্ট বাইন্ডার, অ্যাবডোমিনাল বাইন্ডার, পোস্ট অপারেটিভ রোগীদের জন্য ওয়েস্ট-শেপার, অ্যাঙ্কেল ইনজুরি প্রিভেন্টিভ সাপোর্ট ব্রেস, ব্যাক ইনজুরি প্রিভেনটিভ ব্রেসনি ব্রেসসহ প্রায় ৪০ ধরনের সার্জিক্যাল সরঞ্জাম।

ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের নিজস্ব লিম্ব সেন্টার বন্ধ থাকার সুযোগে এসব দোকান মালিক নিরূপায় রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।

জানা যায়, এসব স্টোরে কৃত্রিম পায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। মানভেদে কৃত্রিম পা ৩০ হাজার থেকে সাত লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দামি কৃত্রিম পা জার্মানি, চীন ও ভারত থেকে আমদানি বলে দাবি দোকানিদের।

আগারগাঁও কলাপাতা রেস্টুরেন্টের সামনের গলির একটি ভবনের নিচতলায় মো. সেলিমের তত্ত্বাবধানে সব ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি হয়। সরকারের লাইসেন্স ছাড়াই কাজ চালাচ্ছেন তিনি। সেলিম আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টারের ব্যানারে এটা তৈরি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত নিজাম উদ্দিন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন।

নিজাম উদ্দিন বলেন, আমরা সব ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ এখান থেকে সাপ্লাই দেই। তবে আরও কারখানা গড়ে ওঠায় আমাদের চাহিদা বাড়ছে না।

সেলিম সার্জিক্যাল আর্টিফিশিয়াল লিম্ব স্টোরের মালিক মো. সেলিম বলেন, আমাদের কাছে সব ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ পাওয়া যায়। ৩০ হাজার থেকে শুরু করে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত। পায়ের চাহিদা বেশি। চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বাড়তি দাম রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাড়তি দাম রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। সঠিক দামে মানসম্মত কৃত্রিম অঙ্গ বিক্রি করি আমরা।

লিম্ব তৈরির বিষয়ে সরকারের অনুমতি আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, আমাদের সেন্টার তৈরিতে সরকারি অনুমতি নেই। আগে ট্রেনিং সেন্টারও ছিল না। ৪০ থেকে ৫০ বছর এই ব্যবসা করছি। কাজ করতে করতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।

এসব কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও এর স্বাস্থ্যঝুঁকি বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিত কুমার কুন্ডু বলেন, কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়। সারাজীবন আমরা নিজের পা দিয়ে হেঁটে অভ্যস্ত। হঠাৎ করে অন্য একটা পা বসিয়ে দেওয়া হলো, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। শরীরের নানা বিষয় ও অ্যানাটমি চেক করেই কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করে রোগীর দেহে সংযোজন করতে হবে। এছাড়া কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের পর নিয়মিত একটা ট্রেনিং করতে হবে। ট্রেনিং না করলে ভিন্ন একটা পার্ট আমাদের দেহ গ্রহণ করবে না। যদি না করে তবে নানা ধরনের সমস্যা ও জটিলতা তৈরি হবে। যেমন- আলসার হতে পারে। এছাড়া হাড়ের সমস্যা হবে।

‘রোগী কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার করে স্বস্তির বদলে বার্ডেন (অস্বস্তি) মনে করবে। এতে শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতা তৈরি হবে। তাই দোকানে এর সমাধান মিলবে না। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এর সমাধান দিতে পারে’ যোগ করেন এই চিকিৎসক।

ফুটপাতের লিম্ব মানহীন কি না প্রশ্নে ডা. ইন্দ্রজিত কুমার কুন্ডু বলেন, এগুলো কারা তৈরি করছে, কোথা থেকে এরা ডিগ্রি নিয়ে এগুলো বানাচ্ছে তার কোনো হিসেব নেই। কৃত্রিম পা সংযোজন করলেই হবে না, এগুলোর সঠিক পরীক্ষা দরকার। শরীর কতটুকু নিতে পারছে এসব অঙ্গ তার পরীক্ষা দরকার, যা ফুটপাতের দোকানে সম্ভব নয়। বরং ফুটপাতের এসব কৃত্রিম অঙ্গ জটিলতা তৈরি করছে।

পঙ্গু হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতি মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াইশ কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করা হতো এ লিম্ব সেন্টারে। এখন তা বন্ধ। তদারকির অভাব ও লোকবল সংকট এর অন্যতম কারণ। তবে বছরে ও মাসে কত সংখ্যক অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয় সে তথ্য পাওয়া যায়নি। লিম্ব সেন্টারে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি।

এসব বিষয়ে নিটোরের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল গণি মিয়া বলেন, করোনা সংকটসহ নানা কারণে বর্তমানে লিম্ব সেন্টার বন্ধ। ভারতের একটা টিমের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। আশা করছি দ্রুততম সময়ে এটা চালু করতে পারবো। তখন ভুক্তভোগীরা এখান থেকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করতে পারবেন স্বাচ্ছন্দ্যে।