শ্রমিক সংকট দূর করতে কৃষিতে বাড়ছে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার। এর ফলে ধানের চারা রোপণ থেকে শুরু করে কাটা-মাড়াই ও পরিবহনে উপকৃত হচ্ছেন কৃষক।

চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে নওগাঁর ওপর দিয়ে কয়েক দফা ঝড়-বৃষ্টি বয়ে যাওয়ায় ধান মাটিতে শুয়ে পড়েছে। শ্রমিক সংকটে জমিতে পড়ে থাকা ধান থেকে চারা গজিয়েছে। বাড়তি মজুরি দিয়েও মেলেনি শ্রমিক। এক্ষেত্রে জেলায় পর্যাপ্ত কম্বাইন হারভেস্টার থাকলে দুর্ভোগ কমতো বলে মনে করছেন কৃষকরা।

তারা বলছেন- কম্বাইন হারভেস্টার কম থাকায় অনেক কৃষক ধান কাটাও মাড়াই করতে পারেননি। এ যন্ত্রটি জেলায় আরও বেশি পরিমাণ দরকার। এতে শ্রমিক সংকট নিরসনের পাশাপাশি কম খরচে ধান কাটা-মাড়াই করতে পারবেন তারা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে জেলায় ১১টি হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় একটি, রানীনগরে তিনটি, আত্রাইয়ে একটি, পত্নীতলায় দুইটি, ধামইরহাটে একটি, মান্দায় দুইটি এবং নিয়ামতপুরে একটি। ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন করে আরও ১৯টি বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, ধান রোপণ ও কাটা-মাড়াই ছেড়ে এখন অনেক শ্রমিক পেশা পরিবর্তন করে পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। অনেকে আবার রাজধানীতে রিকশা চালান, কেউ কেউ এলাকাতেই ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছেন। এতে ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিকের সংকট দেখা যাচ্ছে। এছাড়া মাড়াই মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হলে কৃষকদের ভোগান্তি কয়েকগুণ বাড়ে। এসময় বেশি মজুরি দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। তাই ফসল উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় বাড়ছে।

কৃষকের এই ভোগান্তি অনেকটাই কমাতে সহায়ক কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এ মেশিনটির সরবরাহ নওগাঁ জেলায় অনেক কম। কৃষিকে আরও সহজতর করতে সরকারের পক্ষ থেকে মেশিনটির বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন জেলার কৃষকরা। এতে করে ধান কাটা-মাড়াইয়ে যেমন কৃষকদের খরচ কমবে সেইসঙ্গে ভোগান্তিও অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।

বদলগাছী উপজেলার চাকরাইল গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন বলেন, এ মৌসুমে ঝড়ে ধান মাটিতে পড়ে যাওয়ায় বিঘাপ্রতি ৮-৯ হাজার টাকা মজুরি দিয়ে ধান কাটা-মাড়াই করতে হয়েছে। এছাড়া জমিতে যে পরিমাণ ধান হবে কাটা-মাড়াইয়ের পর অর্ধেক দিয়ে দেওয়ার চুক্তিতেও শ্রমিক নিতে হয়েছে। এতে আমাদের খরচ অনেক বেশি পড়েছে।

তিনি বলেন, ধান মাড়াইয়ে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের খুব চাহিদা রয়েছে। মেশিনে সিরিয়াল দিয়ে ধান কেটে নিতে হয়েছে। আবার অনেক কৃষক সুযোগ না পেয়ে ধান কেটে নিতে পারেননি। যদি এ মেশিন সহজলভ্য হতো তাহলে বিঘাপ্রতি ৪-৬ হাজার টাকা খরচেই ধান মাড়াই হয়ে যেত। এতে করে আমাদের অনেক খরচ কম পড়তো। কৃষকদের মাঝে ভর্তুকিতে আরও বেশি পরিমাণ এ মেশিন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

কামারবাড়ি গ্রামের ফেরদৌস হোসেন বলেন, ঝড়ে যে ধান জমিতে শুয়ে পড়েছে কিন্তু কাদা নেই সেসব ধানও দেখছি মেশিন দিয়ে কাটা হচ্ছে। কিন্তু জমিতে শুয়ে পড়া যে ধান বৃষ্টির পানিতে কাদার সঙ্গে লেপ্টে গেছে সেসব ধান মেশিন দিয়ে কেটে দিতে চাচ্ছে না। মেশিনের মালিকরা বলছেন, ওই জমির ধান কাটার সময় ছাঁকনিতে পানি ঢুকে আটকে যাবে। এতে তাদের ক্ষতি হবে।

তিনি আরও বলেন, এ মেশিনের বেশ সুবিধা আছে। জমি থেকে ধান কেটে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে। এতে খরচ একটু বেশি হলেও কৃষকের ভোগান্তি কমেছে।

উপজেলার কামারবাড়ি গ্রামের কম্বাইন হারভেস্টার মালিক মিলন হোসেন সোহাগ বলেন, চলতিবছর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে এ মেশিনটি পেয়েছি। বাজার মূল্যের অর্ধেক ১৮ লাখ টাকা দিতে হবে। পাঁচ লাখ টাকা নগদ জমা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত মোট ৮ লাখ টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা মৌসুমে কাজ করে দুই বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

তিনি বলেন, বিঘাপ্রতি চার হাজার টাকায় ধান কাটা ও মাড়াই করা হয়। এক বিঘা খাড়া ধান কাটতে প্রায় ২৫-৩০ মিনিট সময় লাগে। তেল খরচ হয় ৭-৮ লিটার। আর শুয়ে পড়া ধান কাটতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। এতে তেল খরচ হয় ১৪-১৫ লিটার। এক্ষেত্রে জমির ধানের ধরন এবং জমি থেকে রাস্তার দূরত্বের ওপর নির্ভর করে মাড়াইয়ের টাকা কিছুটা কমবেশি হয়ে থাকে।

হারভেস্টার মালিক মিলন বলেন, এলাকায় মেশিনটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে- মেশিনে কোনো ধরনের ত্রুটি হলে কোম্পানির মেকারকে (মেরামতকারী) ফোন করলে এসে ঠিক করে দেন। কিন্তু মেশিনের যন্ত্রপাতিগুলো এখনো সহজলভ্য না হওয়ায় অনেকটা ভোগান্তি পোহাতে হয়। যন্ত্রপাতি কিনতে হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী যেতে হয়। যদি মেশিনের যন্ত্রপাতিগুলো সহজে পাওয়া যেত তবে আমাদের জন্য আরও সুবিধা হতো।

বদলগাছী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান আলী বলেন, কৃষির আধুনিকায়ন এবং যান্ত্রিকীকরণ হলে তা কৃষকের জন্য লাভজনক হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৃষিতে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করতে এরইমধ্যে সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

তিনি বলেন, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এর আওতায় বিভিন্ন আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- কম্বাইন হারভেস্টার (ধান কাটা ও মাড়াই), রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার (ধান রোপণ যন্ত্র), পাওয়ার থ্রেসার (ধান মাড়াই যন্ত্র), ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, ধান কাটার যন্ত্র রিপার ও রিপার বাইন্ডার, পাওয়ার ড্রায়ার সংযুক্ত হয়েছে। কৃষিতে আধুনিক এসব যন্ত্রপাতি আসায় কৃষকরা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকের সংকট দূর হচ্ছে।