কোরবানির ঈদের এখনো বাকি প্রায় দেড় মাস। পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পশুর ব্যাপারী ও খামারিরা। ব্যাপারীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে গৃহস্থ ও খামারিদের কাছ থেকে গরু কিনছেন। অনেক গৃহস্থ ও খামারি সরাসরি হাটে নিয়ে গরু বিক্রির প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। দুই-তিন সপ্তাহ পর থেকেই জমে উঠবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন পশুরহাট। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে এবারও পশুর সংকট নেই, আমদানির প্রয়োজন হবে না। তবে অধিদপ্তরের মতো খামারি-ব্যাপারীরাও বলছেন, পশুর দাম এবার কিছুটা চড়া থাকবে।
তারা বলছেন, ছয় মাস আগে গো-খাদ্যের যে দাম ছিল, তা এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত সাড়ে পাঁচ মাসে গো-খাদ্যের দাম ধীরে ধীরে বাড়লেও সবশেষ ১৫ দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অধিকাংশ গো-খাদ্যের দাম। ঈদের আগে এই একমাসের মধ্যে গো-খাদ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। ফলে এবার চড়া হতে পারে কোরবানির পশুর বাজার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবশেষ ১৫ দিনে গো-খাদ্যের দাম মণপ্রতি ২শ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গরুর অন্যতম খাবার গমের ভুসি। গত তিনদিনের ব্যবধানে এ ভুসির ৩৭ কেজির বস্তার দাম বেড়েছে ৪শ টাকা। আগে এক বস্তা ভুসির দাম ছিল ১৮শ টাকা। দাম বেড়েছে ধানের কুড়া ও গমের ছালেরও। বস্তাপ্রতি এ দুই ধরনের গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। সরিষার খৈল, ছোলার ভুসি, খেসারি, মাষকালাইয়ের ভুসিরও দাম বেড়েছে। শনিবার (২১ মে) বাজারে সরিষার খৈল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা, ছোলার ভুসি ৫৫, খেসারি ৫৬-৫৭ টাকা দরে।
ছয় মাসের ব্যবধানে মাষকলাইয়ের ভুসির দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা। আগে এক বস্তা মাষকলাইয়ের ভুসির দাম ছিল ১১শ টাকা থেকে ১২শ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৪শ থেকে ১৪শ ৫০ টাকা। ছয় মাস আগে সরিষার এক বস্তা খৈল বিক্রি হতো দুই হাজার ৫শ টাকা থেকে দুই হাজার ৬শ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে তিন হাজার ৩শ টাকা থেকে তিন হাজার ৪শ টাকা। একই সময়ে অ্যাংকর ডালের ভুসির ৩৫ কেজির বস্তার দাম ছিল ৮শ টাকা, যা এখন বেড়ে হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।
ব্যাপারীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৬শ টাকা। সেই হিসাবে তিন মণ ওজনের একটি গরুর দাম পড়ছে ৭২ হাজার টাকা। তবে ঈদুল ফিতরের আগে থেকে গরুর মাংসের বাজার ওঠানামা করছে। ঈদের আগে গরুর মাংসের কেজি ৭শ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ৭শ টাকা কেজি ধরলে তিন মণের গরুর দাম পড়বে ৮৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ কেউ তিন মণের একটি গরু কিনতে চাইলে ১২-১৩ হাজার টাকা বেশি গুনতে হতে পারে।
২৮ বছর ধরে গরুর ব্যবসা করছেন কুষ্টিয়ার নাসির উদ্দিন। কয়েক মাস ধরে তিনি এলাকায় ঘুরে ঘুরে গরু কিনছেন। ঈদের আগে তিন-চার মাস খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে বিক্রি করবেন লাভে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক গরু কিনেছেন তিনি।
নাসির উদ্দিন বলেন, দেশে গরু আছে। গরুর সংকট নেই। যে গরু আছে, তা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে দামটা একটু বেশি পড়বে। গত বছর কোরবানিতে সর্বোচ্চ ৬শ টাকা কেজি মাংস ধরে গরু কিনেছি। এবার সেটা বেড়ে ৭শ টাকা কেজিতে ঠেকেছে। মাংসের দাম হয়তো আরও বাড়বে। কেজিতে যদি একশ টাকা করে বাড়ে, তাহলে মণপ্রতি বাড়ছে চার হাজার টাকা। চার মণ ওজনের একটি গরুর দাম ১৬-১৮ হাজার টাকা এবার বেশি পড়বে।
গো-খাদ্যের দাম বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গরুর খাদ্যের দাম খুব বেশি বেড়েছে। তিন মাস আগে যে ভুসির দাম ১৪শ টাকা ছিল, তা এখন ২২শ টাকায় কিনতে হচ্ছে। খৈল, ধানের কুড়া, ভুসির দাম বাড়লে গরুর দামও বাড়বে। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি ২শ গরু কিনেছি। এখন খামারে রেখে খাওয়াচ্ছি। প্রতিদিন খাবারের পেছনে তো খরচ হচ্ছে। গরুর এ খরচ তো আমাকে গরু থেকেই ওঠাতে হবে। খরচ তুলে দুই টাকা লাভের আশা তো করা অপরাধ না। গরুর খাদ্যের দাম যদি আরও বাড়ে, দামটা বেশি ধরতেই হবে। তখন হাটে গরু বেচতে গেলে ক্রেতাদের সঙ্গে খুব বচসা হবে। তারা তো বুঝবে না খরচটা কত হলো।
ব্যাপারীদের পাশাপাশি অনেক খামারি নিজেরাই গরু হাটে নিয়ে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ‘সাদিক অ্যাগ্রো’ নামে একটি খামার রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে। এ খামারে আসন্ন কোরবানির ঈদ ঘিরে দেড় হাজারের বেশি গরু প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে দেড় লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। ১৪শ কেজি ওজনের ব্রাহমা জাতের একটি গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে সর্বোচ্চ।
বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব গরু কেনা হয় বলে জানালেন সাদিক অ্যাগ্রোর ইনচার্জ মো. মাঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, কোরবানির প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা বড় গরু সংগ্রহ করেছি। তবে এবার দাম একটু বেশি পড়েছে। আমাদের খামারে আনার পরও খরচ বেশি পড়ছে। গো-খাদ্যের দাম বেশি, গরুর পেছনে খরচ বেড়েছে।
চাহিদা মিটবে দেশের গরুতেই
কোরবানির পশুর চাহিদা ও প্রস্তুতি নিয়ে এ বছর এখনো স্পষ্ট তথ্য নেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে। মাঠপর্যায়ের তথ্য পেতে অধিদপ্তর থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে সার্বিক তথ্যের ভিত্তি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, দেশে প্রস্তুত হওয়া পশু দিয়ে এবারও কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব।
অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত কোরবানির ঈদে সারাদেশে পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। যার মধ্যে গরু-মহিষ ছিল ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার, ছাগল-ভেড়া ছিল ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ও অন্যান্য পশু ছিল চার হাজার ৭৬৫টি। ওই বছর করোনার প্রকোপ থাকায় কোরবানির পশু বিক্রি কিছুটা কম ছিল।
তবে এবার করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসায় গত কোরবানির ঈদের তুলনায় পশুর চাহিদা ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। মাঠপর্যায় থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পেতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিঠি পাঠিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। গত ১০ মে এ চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির উত্তর এলে কোরবানির পশুর সংখ্যা ও চাহিদা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মিলবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জিনাত সুলতানা বলেন, ‘গত ১০ মে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিঠি পাঠিয়েছি। এটা আসতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে। তবে এটা স্পষ্ট যে, দেশে কোরবানির গরুর সংকট নেই। দেশে প্রস্তুত করা গরু দিয়ে কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় গরুর দামও বাড়তি থাকতে পারে।’
কোরবানির পশুর চাহিদা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য এবার ভালো। আশা করছি, গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়তি চাহিদা হবে। তবে চাহিদা বাড়লেও গরুর সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। দেশের খামারে পর্যাপ্ত গরু প্রস্তুত আছে। আশা করি, কোরবানিতে চাহিদা মিটিয়েও গরু মজুত থাকবে। কোনোভাবেই বিদেশ থেকে গরু আনার প্রয়োজন হবে না।’