জ্বালানি সংকট, রিজার্ভ ঘাটতি, মূল্যবৃদ্ধি-মুদ্রাস্ফীতি, খাবার সংকট আর সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যেই নতুন আরেক বিপদের মুখোমুখি হতে চলেছে শ্রীলংকা। আগামী ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই ভয়াবহ খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে শ্রীলংকা। বুধবার প্রকাশিত বার্তাসংস্থা আলজাজিরার এক সরেজমিন প্রতিবেদনে দ্বীপরাষ্ট্রের ভয়ংকর এ চিত্র উঠে এসেছে। দেশটির পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক জিউইকা ওয়েরাহেওয়াও এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘চলমান খাদ্য সংকট আরও বড় আকার ধারণ করবে। পরবর্তী চার অথবা ছয় মাস শ্রীলংকার জন্য আরও কঠিন সময়।’

‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, আমি জানি না এখন কী করব? আমি একবার আকাশের দিকে তাকাই, আরেকবার মাটির দিকে। আর অপেক্ষা করি’, এভাবেই নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়া ওয়ালসাপুগালা এলাকার কৃষক মাহিন্দা সামারাবিক্রেমা (৪৯)।

দেশটিতে বছরের এই সময়ে, কলাখেতের বেশিরভাগ গাছের উচ্চতা হতো দ্বিগুণ। ফুলে ফুলে ভরে উঠত গাছগুলো। কিন্তু এই কৃষকের আগাছা ছড়ানো মাঠের ১ হাজার তিনশটি গাছের মধ্যে মাত্র কয়েকটিতে ফুল এসেছে। জমিতে চাষ করে বছরে ৩৭ হাজার কেজি কলা পেতেন তিনি। অথচ এবার মাত্র ৬ হাজার কেজি কলা পেতে পারেন। রাসায়নিক সারের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরে গত মার্চের ফসল কাটার সময় তার ধানের ফলন অর্ধেকে কমে যায়। ৮ হেক্টর (২০ একর) জমিতে ধান এবং কলাবাগানের মালিক সামারাবিক্রেমা বলেন, তার এখন একটি খামার পরিচালনার মতো আয় নেই। বিশেষ করে কলার ফলনও ব্যর্থ হওয়ায় এই মৌসুমে আর ধান চাষও করবেন না তিনি। সামারাবিক্রেমার মতো ওয়ালসাপুগালা গ্রামের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র কৃষকরা বলছেন, তারা এই মৌসুমে তাদের খেতে সেচ দেবেন না। শ্রীলংকায় মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলা এই মৌসুমকে বলা হয় ইয়ালা মৌসুম। কৃষকদের মতে, সার নিষেধাজ্ঞা কারণে ফসলের চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া দেশব্যাপী জ্বালানির ঘাটতির এই কৃষি ব্যবস্থাকে আরও করুণ করে তুলছে। বেগুনচাষি কেএ সুমনদাসা বলেন, এখন আর চাষ করে লাভ নেই।

কেএ সুমনদাসা বলেন, এখন আর চাষ করে লাভ নেই। তিনি তার এক হেক্টর (শূন্য দশমিক ছয় একর) জমিতে বেগুন চাষ করেন। ৭০ বছর বয়সি এই বৃদ্ধ শাক-সবজির একটি ব্যাগ থেকে অনেকগুলো ছত্রাকযুক্ত ফসল বের করে বলেন, অর্গানিক কৃষিতে স্থানান্তরের ফলে তার ফলন প্রতি মৌসুমে ৪০০ কেজি (৮৮২ পাউন্ড) থেকে ৫০ কেজিতে (১১০ পাউন্ড) নেমে এসেছে। সুমনদাসা বলেন, তার খামারে যে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তা তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, আমি এখন চাষের ঝুঁকি নিতে পারি না। আমি শুধু আমার পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য চাষ করব। ভূমি ও কৃষি সংস্কার আন্দোলন (এমওএনএলএআর) নামে একটি বেসরকারি সংগঠন বলছে, হাম্বানটোটা জেলায় এবং উত্তরের প্রধান কৃষি অঞ্চলে যেমন অনুরাধাপুরা ও পোলোনারুওয়া জেলার অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষকও এই মৌসুমে চাষাবাদ বন্ধ করে দিচ্ছেন। শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এই সংকট যেখানে দেশটি এরই মধ্যে আমদানি করা খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করছে। এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত খাদ্যেরও ব্যাপক ঘাটতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা। শ্রীলংকার কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির প্রেসিডেন্ট গামিনি সেনানায়েকে বলেন, খাদ্যের দিক থেকে আগামী কয়েক মাসে খুব কঠিন সময় আসবে। খাদ্য ঘাটতি হবে … আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা এক সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু সার ও কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃত্রিম কৃষি রাসায়নিক পণ্য নিষিদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।

দেশকে সম্পূর্ণরূপে জৈব কৃষিতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল তার। এটিই শ্রীলংকার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। গত বছরের মে মাসে রাতারাতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল গোতাবায়ার সরকার। দেশটির ২০ লাখ কৃষক তখন পর্যন্ত ভর্তুকিযুক্ত রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তারা হঠাৎ করেই বিপাকে পড়েছেন। দেশের ৩০ শতাংশ শ্রমশক্তিই এই কৃষকরা। প্রধান উৎপাদিত ফসল ধানের উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। যার ফলে চলতি বছর সরকার তিন লাখ টন চাল আমদানি করেছে। যেখানে ২০২০ সালে আমদানি করা হয়েছে ১৪ হাজার টন। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। ঘাটতির কারণে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি, ডিজেলের জন্য দীর্ঘ সারি, ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন-এ ধরনের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে দেশটিতে।

শ্রীলংকার এমন দুর্দশার জন্য সরকারি অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে এবং রাজাপাকসে ও তার প্রতাপশালী ভাইদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নামেন। বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্টের ভাই বাসিল রাজাপাকসে ও চামাল রাজাপাকসে, একই সঙ্গে নামাল রাজাপাকসে গত মার্চ মাসে মন্ত্রিসভা ছেড়ে দেন। এরপর আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্টের ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। যদিও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া বহাল তবিয়তে আছেন এবং তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। বরং অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য করোনা মহামারি, ঋণের বোঝা ও পর্যটন খাতে ধসের মতো অজুহাত দেখানো হচ্ছে। গত এপ্রিলে কৃষিমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত জনকা ওয়াককুম্বুরা মে মাসের শুরুতে বলেন, জৈব কৃষিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত আসলে দ্রুত নেওয়া হয়েছে এবং আমরা ত্রুটিগুলো বুঝতে পেরেছি। শিগগির কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ করার কথাও বলেন তিনি।

কিন্তু এপ্রিলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৮০ কোটি ডলারে। এছাড়া রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে বিশ্ববাজারে সারের দামও বেড়ে যায়। শ্রীলংকার কৃষি বিভাগের সাবেক শীর্ষ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিওনেল ওয়েরাকুন বলেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে ২০২০ সালে সার আমদানিতে প্রায় ২৫৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে রাশিয়া, বেলারুশ ও চীনের সার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে।

তিনি বলেন, যদি আমরা ২০২০ সালের মতো একই পরিমাণ সার কিনতে চাই, তাহলে আমাদের ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সামনে শ্রীলংকার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। কারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশে রয়েছে, তা আরও বাড়তে পারে।