নীতিমালায় আছে মেট্রোপলিটন এলাকায় বেসরকারি মেডিকেল হতে হলে কলেজ ও হাসপাতালের জন্য দুই একর জমি থাকতে হবে। কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে থাকতে হবে ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেস।
কিন্তু স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শ্যামলীতে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিজস্ব কোনো জমিই নেই। ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু এই কলেজই নয়, অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল এমন অনিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকে জানিয়েছেন, বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু কার্যত তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনা আইন তৈরি হয়নি। নামকাওয়াস্তে একটি নীতিমালা থাকলেও অনেক তা মানছে না।
অথচ নীতিমালার ২.৩ নির্দেশনা অনুযায়ী ভাড়া বাড়িতে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার বিধান নেই। ৯.৪ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কেউ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল হবে।
কিন্তু দেশে ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধিকাংশই চলছে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে। তাই অনেকের প্রশ্ন-এসব প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক কে, আসল গলদটা কোথায়?
উত্তরটাও অনেকে জানেন, যেসব প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে যারা ফাঁকফোকর রেখে এসব হাসপাতালের লাইসেন্স পেয়েছে।
শর্তপূরণ ছাড়াই যাকে-তাকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার পেছনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও আছে। তারা মনে করেন, এ চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এ অরাজকতা বন্ধ হবে না।
এ ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে আছি। দেশে ফিরে বিস্তারিত কথা বলতে পারব। বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন।
অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. একেএম আহসান হাবিব বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার মানোন্নয়নে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে তথ্য জানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরে সাতটি কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময় উচ্চ আদালতে রিট করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। অধিদপ্তর একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিলেও উচ্চপর্যায়ের তদবিরের কাজ করছে।’
নীতিমালায় বলা আছে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিজস্ব জমি ও ফ্লোরস্পেস ছাড়াও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অধিভুক্তি হালনাগাদ, হাসপাতালে ৫০ জন রোগীর জন্য ২৫০টি বিছানা হিসাবে ৯০ জনের জন্য ৪৫০টি বিছানা থাকা আবশ্যক।
এছাড়া ৭০ শতাংশ বেড অকুপেন্সি রেট ও এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত থাকতে হবে। মেডিকেল কলেজ নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ১০ জনে একজন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ২৫ জনে একজন সহকারী থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত শিক্ষক থাকতে হবে।
শ্রেণিকক্ষ, মিউজিয়াম, ল্যাবের পরিসর ও সরঞ্জাম বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া সার্ভিস রুল, অর্গানোগ্রাম, তিন মাস অন্তর গর্ভনিং বডির সভা, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স স্কিম কার্যক্রম নিয়মিত হতে হবে। এভাবে নীতিমালায় পূর্ণাঙ্গ ও একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পূর্ব শর্ত হিসাবে বিস্তর নির্দেশনা দেওয়া আছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ত্রণালয় এবং বিএমডিসসহ তিন জায়গা থেকে রেগুলেশন হয়। তিন সংস্থার গাইডলাইনের আলোকে কলেজগুলো পরিচালিত হবে। যাদের গাইড করবে মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাদের সমন্বয় না থাকায় কিছু প্রতিষ্ঠান সুযোগ নিচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ইউনিফর্ম নীতিমালা বা সার্ভিস রুল নেই। যেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করবে। মূলত প্রয়োজনীয় সমন্বয় না থাকা এবং জবাবদিহিতার অভাবে এমনটি হচ্ছে। তবে অনেক কলেজ চিকিৎসা শিক্ষাদানে বেশ ভালো করছে এজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।’
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ১০৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য মোট আসন সংখ্যা ১০ হাজার ৬৯৭টি। এরমধ্যে ৩৭টি সরকারি কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ এবং বেসরকারিতে ৬ হাজার ৩৪৭টি আসন রয়েছে। বিভিন্ন সময় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে সেখানে নানা অসঙ্গতি দেখা গেছে। তবে সংকট কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানোন্নয়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত বছরের ১৩ অক্টোবরের পর থেকে মাত্র ২৮টি ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়নি।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর তেজগাঁওয়ে বেসরকারি এমএইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতাল ভিজিটে যায় অধিদপ্তর। এরপর চলতি বছরের এপ্রিলে একটি মতামত প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে উল্লেখ্য করা হয়, নীতিমালা অনুযায়ী কলেজটি অবশ্যকীয় শর্তাবলী পূরণ করেনি।
কলেজের একাডেমিক কার্যকর্মের জন্য ৯৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস, হাসপাতালের জন্য ৮৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস, কলেজ ও হাসপাতালের জন্য ১১৭ দশমিক ৫ শতাংশ জমি এবং ৪১৩টি শয্যা ঘাটতি আছে। বিএমডিসির অধিভুক্তি হালানাগাদ থাকা বাধ্যতামূলক হলে ২০১২ সালের পর থেকে তা করা হয়নি।
৫৮ শতাংশ বেড অকুপেন্সি ঘাটতিসহ প্রায় সব বিভাগে শিক্ষক, ল্যাব, শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জাম, লাইব্রেরির আসন এবং সার্ভিস রুলের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য ২০১৮-১৯ থেকে সর্বশেষ ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের জন্য একাডেমিক অনুমোদন নবায়ন করার পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে সব শর্তাবলীর দৃশ্যমান উন্নয়ন আবশ্যক বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া বিদম্যান পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির আসন বৃদ্ধির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর কমিটির কাছে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ (বেসরকারি) পরিদর্শন শেষে সেখানে ৫০ হাজার বর্গফুট, হাসপাতালে এক লাখ ২ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেস ঘাটতির তথ্য বেরিয়ে আসে। রোগীর চিকিৎসার জন্য ২৬০টি শয্যা, ৪৮ শতাংশ বেড অকুপেন্সি, ২টি গ্যালারি, ১২টি টিউটোরিয়াল রুমের ঘাটতি পাওয়া গেছে। কলেজের নামে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত ও শিক্ষকের ঘাটিত পাওয়া গেছে। এ কারণে ৬ মাসের মধ্যে এসব শর্ত পূরণ করে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রমের সুপারিশ করা হয়।
২০১৯ সালের ১৩ মে মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০টি আসনের বিপরীতে নীতিমালা অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানটিও সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পারেনি। পর্যাপ্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে পারেনি বিগত বছরগুলোতে। ফলে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী ভর্তিতে আসন বাড়ানোর জন্য অনুমোদন চাইলেও তা দেওয়া হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৩ মাসের মধ্যে মেডিকেল কলেজের ১১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ জমি, শিক্ষক বৃদ্ধি, ক্লাসরুম পরিবর্তন, সার্ভিস রুলের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারলে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। এগুলো বাস্তবায়ন না করলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
একই বছর ধানমন্ডি এলাকায় বেসরকারি জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজে পরিদর্শন প্রতিবেদনে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ১১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। পরে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কলেজটি পরিদর্শন করা হয়।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজে এক লাখ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। এ হিসাবে শুধু ওই শিক্ষাবর্ষের ১১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ২ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট ফ্লোরস্পেস দরকার। পরিদর্শনে দেখা যায়, কলেজটিতে জায়গাসহ ৯৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে হাসপাতালের কার্যক্রমে ৮৫ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস ঘাটতি আছে।
ফলে ফ্লোরস্পেস বাড়ানো, বিএমএমডিসির অধিভুক্তি হালনাগাদ, হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, মিউজিয়াম হতে টিউটোরিয়াল রুম পৃথককরণ, গ্রন্থাগারের আসন বৃদ্ধি ও একাডেমিক পরিবেশের দৃশ্যমান উন্নয়নের শর্তসাপেক্ষে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে। একশ আসনের বিপরীতে বর্তমান আসন বৃদ্ধির সুপারিশ সম্ভব নয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও চিকিৎসা আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নিয়ে কথা হচ্ছে। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশ লাগে, যা আজ অবধি সম্ভব হয়নি। আইন না থাকায় কোনো রকম একটি নীতিমালা করে পরিচালিত হচ্ছে। এরফলে সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়ে অধিকাংশই নামকাওয়াস্তে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শনে বিএমডিসি, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার রয়েছে। অথচ কোনো সমন্বয় নেই। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও বিএমডিসি কর্তৃক লাইসেন্স ছাড়া প্রায় সব জায়গায় প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করলেও সবাই পেশা-জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে না, দক্ষ হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এজন্য আইন করে মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিতে হবে।’